কক্সবাজার আদালতে সিনহা হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু : ভুক্তভোগীদের মানববন্ধন

কক্সবাজার প্রতিনিধি :

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ।

মামলার বাদী ও সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসকে দিয়ে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ।

২৪ ও ২৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা তিন দিনে মোট ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের কথা আছে।

জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আদালত পরিচালনা করছেন।সাক্ষ্য গ্রহণের সময় আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন মামলার অন্যতম আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ জন আসামি।

সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হওয়ার খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আসামি প্রদীপ কুমার দাশের পক্ষে লড়ছেন বিশিষ্ট আইনজীবী রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসা আইনজীবীরা। এ মামলার মোট সাক্ষী ৮৩ জন।

সকাল সোয়া নয়টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয় সিনহা হত্যা মামলার ১৫ আসামিকে। তাঁরা হলেন পুলিশের তৎকালীন নয় সদস্য ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেবল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেবনাথ। বাকি ছয় আসামি হলেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আবদুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের তিন ব্যক্তি নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। প্রিজন ভ্যান থেকে আসামিদের নামিয়ে আদালতের এজলাসে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রিজন ভ্যান থেকে সবশেষে নামানো হয় ওসি প্রদীপকে। তিনি আদালতের দিকে যাওয়ার সময় উপস্থিত লোকজন হইচই শুরু করেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, গত ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই তিন দিন আদালত সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করলেও লকডাউনের কারণে তা হয়নি। আজ থেকে টানা তিন দিন ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের কথা রয়েছে।

দ্রুতই এই মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে জানিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এই মামলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কোনো সুযোগ নেই। করোনার কারণে কোর্ট বন্ধ ছিল, বিধায় এটা দেরি হয়েছে। আজকে যখন বাদীনির সাক্ষী শুরু হয়েছে। আসামিপক্ষের ১৩ জন আইনজীবী তাকে জেরা করেছেন। আমরা আশাবাদী দ্রুত শেষ করতে পারব।’

মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসও আদালতে হাজির হয়েছেন। সকাল ১০টার দিকে মামলার বাদী ও এক নম্বর সাক্ষী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের জবানবন্দি রেকর্ডের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।

সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ জেনে গত বছরের ৫ আগস্ট আদালতে মামলা করি। আজকে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথম দিনে আমি মূলত জবানবন্দি দিয়েছি। আমাকে আসামিদের আইনজীবীরা জেরা করেছেন। আমি তার জবাব দিয়েছি। এটি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আদালতের কাছে ওসি প্রদীপ লিয়াকতসহ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। আশা করছি, আমি ন্যায়বিচার পাবো।’

এছাড়াও জেরার জন্য সময় প্রার্থনা করে প্রদীপের আইনজীবী আবেদন করলে আদালত মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) সাক্ষীদের জেরার জন্য সময় নির্ধারণ করেন। গত ২৭ জুন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে মামলাটির চার্জ গঠন করা হয়।

আসামিপক্ষের আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘সিনহা হত্যা মামলায় রাষ্ট্র পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। মামলার বাদী মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য আসামিদের আইনজীবীরা তাদের জেরা শেষ করেছেন। তবে ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতের জেরা হবে মঙ্গলবার।

প্রদীপের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে শ্লোগান ও মানববন্ধন করেছে ভুক্তভোগীদের স্বজনরা। সকালে কড়া নিরাপত্তায় কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে ওসি প্রদীসসহ ১৫ জন আসামিকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত চত্বরে হাজারও উৎসুক জনতা ভিড় করে। বিকালে আসামিদের নিয়ে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষ ওসি প্রদীপসহ সব আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শ্লোগান দিতে থাকে। এর আগে সকালেও আদালত ভবন চত্বরে একই দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশে করে ওসি প্রদীপের হাতে নির্যাতিতদের স্বজনেরা।

সোমবার আদালতের সমন দেওয়া পাঁচজন সাক্ষীর মধ্যে তিনজন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস, টেকনাফের শামলাপুরের আবদুল হামিদ এবং শামলাপুরের ইউনুচ সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য হাজিরা দেন। এদিন সিনহার ‘জাস্ট গো’ ডকুমেন্টারি টিমের সদস্য সাহিদুল ইসলাম প্রকাশ সিফাত ও টেকনাফের মিনাবাজারের মোহাম্মদ আলী অনুপস্থিত ছিলেন। সাক্ষ্য গ্রহণ একটানা আরও দুই দিন (২৪ ও ২৫ আগস্ট) চলবে।

মামলাটির চার্জশিটভুক্ত প্রথম ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আদালত থেকে সমন দেওয়া হয়।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) সন্তোষ বড়ুয়া জানান, চলতি বছরের গত ২৭ জুন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল মামলাটির চার্জ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দিয়েছিলেন।

তিনি আরও জানান, এ মামলায় ৮৩ জন চার্জশিটভুক্ত সাক্ষী রয়েছেন। চলতি বছরের ২৭ জুন ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/ ১১৪/১২০—খ/ ৩৪ ধারায় সব আসামির উপস্থিতিতে মামলাটির চার্জ গঠন করা হয়। তার আগে গত ১০ জুন আসামি বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কক্সবাজার জেলা কারাগারে নিয়ে আসা হয়।

এর আগে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় জনকে আসামি করে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি তদন্তভার দেওয়া হয় র‌্যাবকে।

চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর এ মামলায় এজাহারভুক্ত নয়জনসহ মোট ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কক্সবাজার র‍্যাব-১৫-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। এখন ১৫ জন আসামি কারাগারে রয়েছেন।