পাহাড়ে অপহরণ-বাণিজ্য! মুক্তিপণ দিলেই ছাড়! নয়তো গুম-খুন!
পটিয়া প্রতিবেদক:
পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় নিয়ন্ত্রণ রাখতে দীর্ঘদিন তিনটি অস্ত্রধারী গ্রুপ সক্রিয় অভিযোগ রয়েছে।
তারা প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বাগান মালিক ও কাজে যাওয়া শ্রমিকদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি চাকমা গ্রুপ এবং অপর একটি বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে গঠিত সন্ত্রাসী গ্রুপ। তারা জলপাই রঙের পোশাক ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করে থাকে বলে স্থানীয়দের কাছে জানা গেছে।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের পটিয়ায় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অপহরণ-বাণিজ্য চলছে প্রতিনিয়ত। তাদের ভয়ে উপজেলার পাহাড়ি এলাকার লোকজন বর্তমানে আতঙ্কে রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনকে পাহাড়ে ধরে নিয়ে পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রায় সময় উপজেলার কেলিশহর, হাইদগাঁও, কচুয়াই, শ্রীমাই পাহাড় ছাড়াও পাশ্ববর্তী বোয়ালখালী ও চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মহড়া চলছে বলে স্থানীয় দিনমজুর ও কাঠুরিয়াদের অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে পটিয়া, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, দোহাজারি, চন্দনাইশ এলাকার গহীন অরণ্য থেকে আসা এসব সন্ত্রাসীর আনাগোনা বেড়েছে।
সর্বশেষ গেল বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) সকালে পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীমাই পাহাড়ি এলাকায় প্রতিদিনের মতো কৃষিকাজ করতে যান আনু মিয়া। এ সময় একদল পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের গুলিতে আনু মিয়া নিহত হন। গুলি দুটির একটি নিহত আনু মিয়ার কোমরের পেছনে আর একটি বাম পায়ের উরুতে লাগে। নিহত কৃষক আনু মিয়া খরনা ইউনিয়নের ফকির পাড়ার মৃত কালা মিয়ার ছেলে।
এ ঘটনায় নিহত কৃষক আনু মিয়ার ছোট ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পটিয়া থানায়।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিনিট্রাক চালক মোসলেম উদ্দিনকে পূর্ব হাইদগাঁও আলম মাস্টারের প্রজেক্টের পাশ থেকে ১০-১২ সদস্যের উপজাতি সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায়। এ সময় অপহরণকারীরা মুক্তিপণ হিসেবে তিন লাখ টাকা দাবি করে। এ ঘটনায় অপহৃতের বড় ভাই আবু তাহের বাদি হয়ে পটিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে এই মামলার তদন্তভার যায় পিবিআইয়ের হাতে। মোসলেম চন্দনাইশ উপজেলার পশ্চিম এলাহাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। গত দুই বছরেও পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। তবে ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর চন্দনাইশের ধোপাছড়ি থেকে এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা ও পরিতোষ তঞ্চঙ্গ্যা নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।
পিবিআই দাবি করেছেন, ওই দুই আসামি গাড়িচালক মোসলেমকে হত্যার পাশাপাশি তার লাশ গুমের ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এরপরই ওই দুই আসামিকে সঙ্গে নিয়ে গত বছরের ৩১ জুলাই পটিয়ার পূর্ব হাইদগাঁও দুর্গম পাহাড়ের কালামার ছড়ায় অভিযান চালায় পিবিআই। তবে প্রায় পাঁচ ঘন্টা খোঁজাখুঁজি করেও সেখানে লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি।
এর আগে দক্ষিণ শ্রীমাই এলাকার মো. শফি (৪৪) নামের এক ব্যক্তিকেও অপহরণ করে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান সীমান্ত হয়ে উপজাতি সন্ত্রাসীরা পটিয়ার পাহাড়ে প্রবেশ করছে। অস্ত্রধারী এসব সন্ত্রাসী মানুষকে ধরে নিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছে। কেউ টাকা দিতে না পারলে তাকে মারধর করা হচ্ছে। পাহাড়ে যারা লেবু বাগান করেছেন, প্রতিটি লেবু বাগানের মালিকের কাছ থেকে সন্ত্রাসীরা টাকা আদায় করছেন।
পটিয়া-বোয়ালখালী সীমান্তে পাহাড়ের লেবু বাগান থেকে ৩২ বাগান মালিক ও লেবুচাষিকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে ১১ জনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
গত ১২ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার কেলিশহর ইউনিয়নের মৌলভী বাজার এলাকার পাহাড় থেকে সন্ত্রাসীরা ১২ জনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে পরে ছেড়ে দিয়েছে।
এরপর র্যাব, পুলিশ ও সীমান্তের বান্দরবানের ডলুপাড়া ক্যাম্পের সেনাবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
জানা যায়, গত ২৯ এপ্রিল দুপুরে পটিয়া-বোয়ালখালী সীমান্তের কড়লডেঙ্গা পাহাড়ের ছালদাছড়ির মুখ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মুক্তিপণ আদায় করে পরে তাদের ছেড়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। অপহৃত সবাই বোয়ালখালী ও পটিয়ার বাসিন্দা।
ওই লেবু বাগানের মালিক সরোয়ার আলম জানান, প্রতিদিনের মতো তারা কড়লড়েঙ্গা পাহাড়ের লেবু বাগানে কাজ করতে যায়। দুপুরের দিকে ১৫-২০ জনের একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপ অস্ত্রের মুখে ৩০-৩৫ জন লেবুচাষী ও বাগান মালিককে জিম্মি করে নিয়ে যায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের গহিনে নিয়ে গিয়ে তাদের মারধর করে। পরে ২১ জন শ্রমিককে সন্ত্রাসীরা ছেড়ে দিয়ে বাকি ১১ জন বাগান মালিককে আটকে রাখে। ১১ জনের মধ্যে শাহেদ ও আসিফকে ছেড়ে দিয়ে আটকদের পরিবারের কাছে মুক্তিপণের জন্য খবর দেয়। তারা এসে পরিবারের কাছে খবর দিলে পরিবারের লোকজন মুক্তিপণের ব্যবস্থা করে জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনেন। বাকি ৯ জনকে মুক্তিপনের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে মুক্তিপণ হিসেবে দেওয়া টাকার পরিমাণ জানা যায়নি।
পটিয়া কেলিশহরের আহমদ হোসেনের ছেলে বাগান মালিক মো. জাহেদকে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য আটকে রাখে। পরে তাকেও মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।