রমজানের আগেই ভোগ্যপণ্যের বাজারে আগুন, নির্বিকার প্রশাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। অথচ দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে। ভোজ্য তেল, চাল, চিনি, খেঁজুর, ডাল, ছোলা, গুঁড়া দুধ সবকিছুই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। ভোজ্যতেল বিক্রিতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না কেউই।
এদিকে প্রতি বছরের মতো এবারও রোজার আগে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফার নেশায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। এমনটাই অভিযোগ তুলেছেন সাধারণ ক্রেতারা। অপরদিকে রোজার আগেই ক্রেতারা বেশি পণ্য কিনে মজুদ করায় দাম বাড়ছে বলে দাবি বিক্রেতাদের।

সোমবার (১৫ মার্চ) নগরের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য চাল, ডাল, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ সংকট নেই বললেই চলে। পণ্য কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন চট্টগ্রাম মহানগর ও বিভিন্ন উপজেলার পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, ভোগ্যপণ্য আমদানির সংকট নেই। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না আসায় আমদানিকারকরাও বাড়তি দামে পণ্য আমদানি করছেন। পাশাপাশি রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়া ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

নগরে ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ছোলায় কেজি প্রতি বেড়েছে ১০ টাকা। আগে কেজি প্রতি ৫৮ টাকায় বিক্রি হওয়া ছোলা এখন ৬৬ থেকে ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের ছোলা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। খুচরা পর্যায়ে ছোলা কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়।

এদিকে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ছোলায় মণপ্রতি (৩৭ কেজি) ৩০০ টাকা বেড়েছে। খাতুনগঞ্জে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা উন্নতমানের ছোলা মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। মাঝারি মানের প্রতি মণ ছোলা মানভেদে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জে কেজি প্রতি ১০ টাকা বেড়ে মটর ডাল ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মটর ডাল মণপ্রতি বেড়েছে ৪০০ টাকা। ভালোমানের মসুর ডাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায়, মাঝারি মানের মসুর ডাল ৭০ টাকায় এবং মোটা মসুর ডাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুগডাল ১০ টাকা বেড়ে কেজি প্রতি মানভেদে ৯০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের দেয়া তথ্য মতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৯ হাজার ২১৮ টন ছোলা খালাস হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ হাজার ৫২৬ টন বেশি। সবচেয়ে বেশি ছোলা আমদানি করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়া থেকেই প্রায় ১৮ হাজার ৯৭৯ টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৮ টন মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে।

আরেক ভোগ্যপণ্য চিনিতেও নেই কোন সুখবর। চিনিতে মনপ্রতি ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত মাসে ৬০ হাজার ৩৩১ টন চিনি আমদানি করা হয়েছে।

এদিকে সরকার ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেদিকে কর্ণপাত করছেন না কোন ব্যবসায়ী। ভোজ্যতেলের মধ্যে প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলগেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩, পরিবেশক মূল্য ১২৭ এবং খুচরা বিক্রয়মূল্য ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৯০, পরিবেশক মূল্য ৬১০ এবং খুচরা বিক্রয় মূল্য ৬৩০ টাকা। প্রতি লিটার পাম সুপার (খোলা) তেলের মিলগেট মূল্য ৯৫, পরিবেশক মূল্য ৯৮ এবং খুচরা বিক্রয়মূল্য ১০৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

অথচ খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৩০ টাকার বেশি দামে। পাম সুপার ১১২ থেকে ১১৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ৫ লিটার সয়াবিন তেল (বোতল) বিক্রি হচ্ছে ৬৪০ থেকে ৬৫০ টাকায়, যা নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি।

এদিকে পাইকারি পর্যায়ে একমাস আগে ৩ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি মণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম অয়েল ৩ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেল মণপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে। গত মাসে প্রতি মণ সয়াবিন তেল ৪ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তা এখন ৪ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

একইভাবে কেজিতে ৬ টাকা বেড়েছে চিড়ার দাম। খাতুনগঞ্জে কেজি প্রতি ৪৫ টাকায় বিক্রি হওয়া চিড়া এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকায়। তাছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হলুদ কয়েক সপ্তাহ আগে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কেজিতে এখন তা ২০ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকার নারকেল এখন ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজার করতে আসা গৃহিণী রোজিনা আক্তার বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। আর আমরা অসহায়ের মত নিরবে সব সয়ে যাচ্ছি, বাড়তি টাকা দিয়ে পণ্য কিনছি। দাম বাড়াতে এতদম সীমিত পরিসরে কেনাকাটা করেছি।’

খাতুনগঞ্জের আল মদিনা ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবে রোজার আগেই বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি পরিমানে পণ্য কিনে মজুদ বাড়ানোর কারণে দামটাও বেড়ে গেছে।’

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘রমজানকে ঘিরে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ভালোই রয়েছে। তবে আমাদের বাজারের সাথে আন্তর্জাতিক বাজারদরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে আমাদেরকেও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে হয়।’

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘রমজানে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। সে চাহিদা মোকাবেলায় যথেষ্ট পরিমাণে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। মার্চ ও এপ্রিল মাসেও পণ্য আমদানি করা হবে। রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘প্রতিবছর রোজা আসলেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে চাল, ডাল, ছোলা, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সরকার এখনই যদি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, রোজার মাসে সাধারণ ভোগান্তিতে পড়বে। তাই এখন থেকে আমদানি, বিতরণ ও ভোক্তা পর্যায়ে বিপণণে কঠোর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখতে আইনের কঠোর প্রয়োগ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে নগদ অর্থ দণ্ডের পাশাপাশি প্রয়োজনে জেল-জরিমানা নিশ্চিত করতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে বাড়তি দামে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে। সাধারণ মানুষও ভোগ্যপণ্যের বাড়তি দাম দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে অতি শীঘ্রই বাজার মনিটরিং শুরু হবে। এ সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপও তৈরি করা হবে। পাশপাশি যারা পণ্যের দাম বাড়াতে কারসাজি করছেন তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।’