শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহতের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :

ফৌজদার হাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত ও আহত হওয়ার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছে জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম।

শনিবার (১লা এপ্রিল) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্তের সভাপতিত্বে এ প্রতিবাদী সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সাংবাদিকদের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এ সময় ফোরামের নেতারা ফৌজদার হাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত ও আহত হওয়ার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন এবং তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান এ সব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের প্রতি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের সীতাকু- উপজেলায় বঙ্গপোসাগরের উপকূলে ফৌজদার হাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এদেশের একমাত্র জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প। ১৫০টির বেশি ইয়ার্ডের রেজিস্ট্রেশন থাকলেও সক্রিয় ইয়ার্ডের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ টি। এই শিল্পের সাথে সরাসরি প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক জড়িত এবং আরো প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ পরোক্ষভাবে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ শিল্পের ব্যাপক অবদান থাকলেও এ সেক্টরের কর্মরত শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত মৃত্যু পঙ্গুত্বের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে দুর্ঘটনায় মোট ৯৭ জন শ্রমিক নিহত এবং ১২৭ জনের অধিক শ্রমিক মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রতি বারই দুর্ঘটনার কারন, নিহত ও আহত শ্রমিকদের সংখ্যা এবং আহতদের অবস্থান নিয়ে মালিক পক্ষের লুকোচুরি খেলা চলে।

এককভাবে এই শিল্প সারাবিশে^ ও দেশে মারাত্মক দুর্ঘটনা, পেশাগত ব্যাধি ও দুষন প্রবন শিল্প। এসময় সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের যুগ্ম আহবায়ক মো :শফর আলী ও এ এম নাজিম উদ্দিন প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বছরের পর বছর জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প খাতে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ঘটনা ঘটতে থাকলেও দায়ী মালিকদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়না। এ যাবৎ দুর্ঘটনায় শ্রমিক আহত-নিহতের জন্য দায়ী কোন মালিকের বিরুদ্ধে একটিও মামলা হয়নি। এক ধরণের অঘোষিত ইন্ডেমনিটি পেয়ে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের মালিকেরা ক্রমশঃ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে হতভাগা শ্রমিকদের দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের মিছিল কোনভাবেই থামানো যাচ্ছেনা। এর ফলে দেশে এবং বিদেশে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প খাতের ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে। যার দায় মালিক পক্ষ, সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তর তথা শিল্প মন্ত্রণালয় এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার সমুহ নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কোন ভাবেই এড়াতে পারেনা।

সর্বশেষ বিগত ১ ফেব্রুয়ারী ঘটনা উল্লেখ করে ফোরামের নেতারা বলেন, মাদাম বিবির হাটে অবস্থিত কেএসআরএম মালিকানাধীন কবির স্টিল শিপ ইয়ার্ডে কর্মরত অবস্থায় লোহার পাত পড়ে সুজন নামে ১ জন শ্রমিক নিহত হন। ময়না তদন্তের রিপোর্ট এবং পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ থাকলেও কবির স্টিল শিপ ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য নানামুখি অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর জানিয়েছে উক্ত নিহত শ্রমিক অসুস্থ হয়ে বমি করার পর নীচে পড়ে যায় এবং পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন। কোন ধরণের পূর্ব তদন্ত ছাড়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের এমন বয়ান মালিক পক্ষের অপতৎপরতাকে সমর্থন করে। এ ধরনের বক্তব্য ময়না তদন্তের রিপোর্ট এবং পুলিশের সুরতহাল রিপোটের সাথেও সাংঘর্ষিক।

এ সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, কেএসআরএম’র ইয়ার্ডে বিগত ৬ বছরে ২২টি দুর্ঘটনায় ১২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। এমন তথ্য কেএসআরএম ইয়ার্ড কর্মক্ষেত্র হিসাবে কতটুকু অনিরাপদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

অতীতের মতই এবারো শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক পক্ষের কোন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের নেতারা বলেন, কেএসআরএম এ সংগঠিত দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহতের বিষয়ে বিগত ১৪ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট এক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। গঠিত তদন্ত কমিটি শ্রমিক পক্ষের কোন প্রতিনিধির সাথে কোন প্রকার আলাপ আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেনি।

অন্যদিকে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার জন্য বলা হলেও অদ্যাবধি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তদন্ত রিপোর্ট নিয়েও শ্রমিকদের মাঝে এক ধরণের হতাশা এবং সংশয় তৈরি হয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্তের স্বার্থে ইয়ার্ড বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশও মালিক পক্ষ পালন করেনি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

ফোরামের নেতারা আরো অভিযোগ করেন,, শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মস্থলে নিহত শ্রমিকদের ২ লক্ষ টাকা এবং এর সাথে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত ক্রাইসিস কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আরো ৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত, আহত শ্রমিকদেও ১ বছর পর্যন্ত সবেতন ছুটি, সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মালিকের দায়িত্বে চিকিৎসা করানো, পঙ্গু শ্রমিকদেও আড়াই লক্ষ টাকা দেয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও তা সকল ভুক্তভোগী শ্রমিকেরা পাচ্ছে কিনা তার জন্য কোন তদারকি নেই। জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প সেক্টর বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর অধীনে পরিচালিত হলেও বাংলাদেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোন সুবিধাও জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিকেরা পাচ্ছেনা। শ্রমিকদের কোন নিয়োগ পত্র দেয়া হয়না। ২০১৮ সালে ঘোষিত মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী এই সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি মাসিক ১৬০০০ টাকা এবং দৈনিক ৬১৫ টাকা ধার্য করা হয়েছে। মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ কার্যকর করা শ্রম আইনের ১৪৮ ধারা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক হলেও মালিকেরা তা মানছেনা। এই সেক্টরে কর্মরত কোন শ্রমিক সবেতন ছুটি তথা নৈমিত্তিক, পীড়া, অর্জিত, উৎসব কিংবা সাপ্তাহিক ছুটি পায়না। অস্থায়ী ভিত্তিতে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে বিধায় শ্রমিকেরা আহত বা নিহত হলে অনেক ইয়ার্ড মালিক শ্রমিকদের দায়ও নেয়না। জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্পে কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তদুপরি ইয়ার্ডের মালিকেরা নিজেরা সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ না করে ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাজ করায়। এ সকল ঠিকাদারদের অনেকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর হতে নিয়ম মোতাবেক লাইসেন্সও গ্রহণ করেনি। জাহাজ কাটা ছাড়া শ্রমিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোন ধারনাই তাদের নাই। তাই ঝুঁকি নিরসনে কোন ব্যবস্থা তারা নেয়না। এমনকি শ্রমিকদের ন্যুনতমভাবে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষামূলক সরাঞ্জামাদী সরবরাহ করা হয়না। ফলে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই হতভাগ্য শ্রমিকেরা বছরের পর বছর কাজ করে চলেছে। রাতের বেলায় ইয়ার্ডে কাজ না করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও মালিকরা তাও মানছেন না।

শ্রমিকরাও বেশী মজুরির আশায় রাত্রে কাজ করতে বাধ্য হয়। পুরাতন পরিত্যক্ত জাহাজ রিসাইক্লিং সংক্রান্ত ২০০৯ সনের হংকং কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবে উল্লেখ আছে- প্রতিটি পরিত্যক্ত জাহাজ বর্জ্যমুক্ত করে রিসাইক্লিং করতে হবে। কিন্তু অতি মুনাফার লোভে বিষয়টি জাহাজ বিক্রেতা বা ক্রেতা কেউ আমলে নিচ্ছেনা। ফলে পরিত্যক্ত জাহাজে থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ যেমন-সিসা, পারদ, ক্রোমাইটস এবং এসবেস্টস পরিবেষ্টিত পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় বিধায় তাদের ফুসফুসের নানাবিধ জটিল রোগসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে। জীবনের তাগিদে কাজ করতে আসা হতদরিদ্র জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিকদের কাছে কোন বিকল্প না থাকার কারনে অনেকে বাধ্য হয়ে এই পেশাকেই বেছে নিয়েছে। বছরের পর বছর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মালিক পক্ষ।

এসময় সংবাদ সম্মেলন থেকে জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম নেতৃবৃন্দরা জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ১১টি দাবী পেশ করেন।

দাবি সমূহ:

★ কেএসআরএম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডসহ বিগত দিনে সংঘটিত সকল দুর্ঘটনার সুষ্ট ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করে দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

★ জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০,০০,০০০/- টাকা এবং আহত্দের ১৫ লক্ষ টাকা ক্ষতি পূরন প্রদান।

★ বিএসবিআরএ’র ব্যবস্থাপনায় এবং স্ব স্ব ইয়ার্ড মালিকের উদ্যোগে কর্মরত সকল শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (চচঊ)প্রদান।

★ বিএসবিআরএ’র ব্যবস্থাপনায় শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদেও কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ সংরক্ষন।

★ ইয়ার্ড সমূহে আধুনিক, নিরাপদ ও সচল যান্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করন।

★ জাহাজ কাটার পূর্বে জাহাজকে পূর্ণাংগভাবে বর্জ্যমুক্ত করন।

★ দেশের প্রচলিত শ্রম আইন, বিধিমালা ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন সমূহ অনুসরণ করে ইয়ার্ড পরিচালনা করা।

★ ইয়ার্ড শ্রমিকদের দেশের সংবিধান, শ্রম আইন ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘোষণা/কনভেনশন দ্বারা স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিতকরণ।

★ ২০১৮ সালে মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি মাসিক ১৬০০০ টাকা এবং দৈনিক ৬১৫ টাকা কার্যকর করা।

★ ইয়ার্ডকে নিরাপদ ও ঝুকিমুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।

★ দুর্ঘটনার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্ত করা।

জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের পক্ষ থেকে দাবিগুলো কম সময়ের মধ্যে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। অন্যথায়, ফোরামের পক্ষ থেকে কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা আসবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ফোরামের নেতারা।