আজ ২৩ সেপ্টে: বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৮৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী

চট্টলা ডেস্ক :

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন অন্যতম বাঙালি নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৮৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২৩ সেপ্টেম্বর।

১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় গ্রেপ্তার এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড পান করে করে আত্মহত্যা করেন।প্রীতিলতা আরেক বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন দেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন। ওই ক্লাবে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিল।

যাতে লেখা ছিল ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। প্রীতিলতার দলটি ক্লাবটি আক্রমণ করে এবং পরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড পান করে আত্মহত্যা করেন।

প্রীতিলতার পড়াশোনার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছে। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। তার বাবা তাকে চট্টগ্রামের ড. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করেন। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান তিনি। ওই স্কুল থেকে ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন প্রীতিলতা। তারপর ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে। কলেজে পড়া অবস্থায় লীলা নাগের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। লীলা নাগ ওই সময়ে দীপালি সংঘের নেতৃত্বে ছিলেন। এটি ছিল তখনকার ঢাকার একটি বিপল্গবী দল ‘শ্রীসংঘ’-এর নারী শাখা সংগঠন। ১৯২৯ সালে প্রীতিলতা দীপালি সংঘের সদস্য হন।

এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে বিএ-তে ভর্তি হন। তখন থেকে মাস্টারদার নির্দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন তিনি। গড়ে তুললেন এক বিপল্গবী চক্র। যেখানে আরও অনেক মেয়ে সদস্য যোগ দিলেন। মেয়েদের নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে পাঠাতেন।

পাশাপাশি মাস্টারদার নির্দেশে কলকাতার গোপন কারখানায় তৈরিকৃত বোমার খোল সংগ্রহ করতেন তিনি। ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে চট্টগ্রামে গিয়ে বোমার খোলগুলো পৌঁছে দেন বিপ্লবীদের হাতে। এরপর প্রীতিলতা প্রকাশ্য বিপ্লবী কাজে যুক্ত হন।

কলকাতার বিপ্লবী চক্রের সব ধরনের প্রশিক্ষণ তিনি দিতেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মহানায়ক সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দখল হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন অচল হয়ে যায়। টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল, সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, রিজার্ভ পুলিশ ছত্রভঙ্গ ও রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়। সে সময় প্রীতিলতা কলকাতায় ছিলেন। বিএ পরীক্ষা শেষে মাস্টারদার নির্দেশে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে যান তিনি।

১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম অপর্ণাচরণ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ওই একই বছরের মে মাসে প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাস্টারদা তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। ওই বৈঠক চলার সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে বিপ্লবীদের বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে প্রাণ দেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। ওই ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার প্রীতিলতাকে সন্দেহ করতে শুরু করলে মাস্টারদার নির্দেশে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

অন্য একটি বিপ্লবী দল ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে ব্যর্থ হলে প্রীতিলতার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্লাবটি আক্রমণের। ১৯৩২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে এক গোপন বৈঠকে মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করার জন্য একটি গ্রামের উদ্দেশে পুরুষের বেশে রওনা দেন। কিন্তু পথে পাহাড়তলীতে কল্পনা দত্ত ধরা পড়েন। প্রীতিলতা নিরাপদে নির্দিষ্ট গ্রামে এসে পৌঁছেন। সেখানেই প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কাট্টলীর সাগরতীরে প্রীতিলতা ও তার সাথিদের অস্ত্র শিক্ষা শুরু হয়। প্রশিক্ষণ শেষে প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাওয়ার কারণে সবাই অন্ধকারে ছোটাছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সঙ্গে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন।

এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহত্যা করেন তিনি।

মৃত্যুর আগে তিনি মায়ের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মাগো, অমন করে কেঁদো না! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উত্‌সর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?’

শুধু তার নিজের মা নয়, আজও অসাধারণ দেশপ্রেমী ও অসম সাহসী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে অশ্রুসজল চোখে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন দেশপ্রেমী মানুষেরা।