আইন- আদালত:
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পরীর পাহাড়ে ১২ তলার দুটি ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে এখন জেলা আইনজীবী সমিতির আগের নির্মাণ করা পাঁচটি ভবনসহ সেখানে গড়ে উঠা সব অননুমোদিত ভবন অপসারণের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
ইতোমেধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে— পরীর পাহাড়ে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং ৭১টি আদালত ছাড়া বাদবাকি সব স্থাপনাই উচ্ছেদ করতে।
চট্টগ্রামের প্রশাসন সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পথে আগালেও জেলা আইনজীবী সমিতি বলেছে আইনজীবী ভবন রক্ষায় তারা আইনি লড়াইয়ে নামবে।
মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের গোপনীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, চট্টগ্রাম নগরের কেন্দ্রস্থলে পাহাড়ের চূড়ায় প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে অবস্থিত। এ অংশে রয়েছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ সর্বমোট ৭১ টি আদালত।
জেলা প্রশাসকের নামে এখানে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ১১.৭২ একর জায়গা রয়েছে। সরকারি ভবনের বাইরে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গায় ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি পাহাড় এবং টিলা কেটে অবৈধভাবে ৫ টি ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে বলে উল্লেখ করে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ সকল স্থাপনাকে পাহাড় ধস, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদির জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি আবারও সরকারের কোনো সংস্থার অনুমোদন ব্যতিরেকে ‘বঙ্গবন্ধু আইনজীবী ভবন’ ও ‘একুশে আইনজীবী ভবন’ নামক দুইটি ১২ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করে এবং ৬০০ টি চেম্বার বরাদ্দের জন্য আইনজীবীদের নিকট থেকে ২ লক্ষ টাকা করে ১২ কোটি টাকা আদায় করেছে।
গোপনীয় রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, এছাড়াও কোর্ট বিল্ডিংয়ের চতুর্পার্শ্বে আইনজীবীগন অর্ধশতাধিক অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ দোকানপাট, খাবার হোটেল, ছাত্রাবাস, বস্তি ও মুদি দোকান তৈরি করে ভাড়া আদায় করছে এবং এই স্থাপনাটিকে একটি অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। এখানকার অরাজকতার সুযোগ নিয়ে ২০১২ সালে এই কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় জঙ্গি হামলাও হয়েছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ও জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ের নিরাপত্তা রক্ষার্থে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরাসমূহও আইনজীবী নেতৃবৃন্দ অপসারণ করেছেন বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনজীবীগণ কর্তৃক সিসিটিভি ক্যামেরা অপসারণ করে ফেলার কারণে অপরাধীরা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইনজীবীদের এ সকল স্থাপনার অনেক বিদ্যুৎ লাইন ও পানির লাইনের সংযোগও অবৈধভাবে নেওয়া হয়েছে।
এতে আইনজীবীদেরকে উশৃংখল আচরণের জন্য দায়ী করে বলা হয়, ইতোপূর্বে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ২ টি বড় কক্ষও দখল করে নিয়েছেন।প্রতিবেদনটিতে প্রস্তাবনা প্রদান আকারে বলা হয়, চট্টগ্রাম কোর্ট হিল এলাকায় সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় শ্রেণির জমিতে ইতোমধ্যে স্থাপিত সম্পূর্ণ অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল স্থাপনাসমূহ অপসারণ করা এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি যেন আবারও অবৈধভাবে খাস জমি দখল করে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সম্মুখস্থ একমাত্র ফাঁকা জায়গাটিতে কোন অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা গ্রহণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন ও বিচার বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। উপরোক্ত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলে তাতে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
মাঠ প্রশাসন সংযোগ অধিশাখার স্মারক নম্বর :০৪.০০.০০০০.৫১২.১৬.০০২.১৮.৩৮৭ মূলে গত সোমবার জারিকৃত সার্কুলারে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় পক্ষের পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গৃহীত প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন।
এই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক বাস্তবায়নের অগ্রগতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করার জন্যও নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আগস্ট ২০২১-এর দ্বিতীয় পক্ষের পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর নিকট উপস্থাপন করা হলে তা অনুমোদন দেয়া হয়।ইট পাথরের জঞ্জালে পরিণত করা হয়েছে ঐতিহাসিক এই পাহাড়টিকে।
এটিকে রক্ষা করে পরীর পাহাড়কে পরীর পাহাড়ের মতো করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাই মন্ত্রী পরিষদ বিভাগকে অবহিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের পরীর পাহাড় থেকে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেছেন, চট্টগ্রামের পরীর পাহাড় তো আর পরীর পাহাড় নেই। পেত্নির পাহাড় হয়ে গেছে।
সকাল ৯টা ১০টার দিকে কোন ভদ্রলোক এখানে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, জজ সাহেব, কিংবা বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে দেখা করতে আসতে চাইলে ভদ্রভাবে আসতে পারবেন না। গাড়ি নিয়ে আসতে পারবেন না। হেঁটে আসতে হবে। ঠিকভাবে হেঁটেও আসা যায় না। ভয়াবহ এক বিশৃংখল অবস্থা পরীর পাহাড় জুড়ে।দিনে দিনে পরীর পাহাড় ইট পাথরের জঞ্জাল হয়ে উঠার কথা উল্লেখ করে বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অবশ্যই অনুসরণ করা হবে।
এখানের পরিবেশ এবং প্রকৃতি রক্ষা করতে আমরা প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবো। তিনি বলেন, পরীর পাহাড়ের পরিবেশ সুন্দর এবং সবার জন্য ভালো রাখার জন্য আমরা সবাই মিলেমিশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।
পরীর পাহাড়কে ঠিক পরীর পাহাড়ের মতোই সরক্ষণ করা হবে বলে উল্লেখ করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেছেন, চট্টগ্রামের পরিবেশ এবং প্রকৃতির অন্যতম এই সম্পদটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। ইট পাথরের জঞ্জাল বানানো হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করে পরীর পাহাড়কে পঞ্চাশ বছর আগেকার পরীর পাহাড় বানানো হবে বলে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী কোন পাহাড় বা টিলার উপর কোনরূপ স্থাপনা করা যাবে না সরকারের পূর্বানুমতি ব্যাতিত। সিডিএ অনুমোদন দিলেও করা যাবে না। পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারটি হচ্ছে আইন আর সিডিএর হচ্ছে নীতিমালা। নীতিমালা থেকে আইন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাহাড় বা টিলার উপর কোনরূপ স্থাপনাই শুধু নয়, কোন পরিবর্তনই করা যাবে না। আপনি ইচ্ছে করলে একটি ট্রাক মাটি ওখান থেকে কেটে নিতে পারবেন না, আবার ইচ্ছে করলে এক ট্রাক মাটি বাইরে থেকে এনে রাখতেও পারবেন না।
আকার আকৃতিতে কোনরূপ পরিবর্তন করা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ।পিআই নীতিমালা অনুযায়ী কেপিআইভুক্ত কোন প্রতিষ্ঠানের পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে কোন ধরনের স্থাপনা গড়ে তুলতে হলে কেপিআই ডিফেন্স কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। যেই কমিটির সভাপতি হচ্ছেন প্রতিরক্ষা সচিব।
পরীর পাহাড়ের পাদদেশের বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। এতে করে কেপিআই নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে স্থাপনা করতে পূর্বানুমতির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই অনুমতি নেয়া হয়নি। কেপিআই ডিফেন্স কমিটির অনুমোদন ছাড়া এখানে কোন স্থাপনা গড়ে তোলার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন জেলা প্রশাসক।
এদিকে পরীর পাহাড়ের ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা প্রসঙ্গে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ এনামুল হক বলেছেন, এমন কোন সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না, আমাদেরকে কেউ কিছু জানাইও নি। তবে আদালত ভবনের সাথে আমাদের ভবনগুলো অর্থাৎ আইনজীবী ভবনগুলো গভীরভাবে সম্পর্কিত। আমাদের সবকটি ভবনের অনুমোদন রয়েছে। আইনগত ভিত্তি রয়েছে। এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে আইনজীবীরা তা কখনও মানবে না। আইনজীবীরা আদালতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদালত ছাড়া আইনজীবী, আইনজীবী ছাড়া আদালত কল্পনাও করা যায় না।
বলা যায়, আইনজীবীদের বাদ দিয়ে আদালতের কার্যক্রম সম্ভব না। যদি এমনটা হয় আমরা আইনের আশ্রয় নিব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সূত্র : দৈনিক আজাদী