বিশেষ প্রতিবেদন :
কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় তার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়ার দায়ের করা নালিশি মামলার এজাহারে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
অভিযোগের বিবরণীতে জানা যায়, পুলিশের তৈরি সুরতহাল রিপোর্ট অনুসারে মৃত্যুর আগে ধস্তাধস্তির শিকার হয়েছিলেন মুনিয়া এবং এর একপর্যায়ে মুনিয়া ধর্ষিতা হন। ডাক্তারি পরীক্ষার বরাত দিয়ে এজাহারে বলা হয়েছে, মুনিয়ার মৃত্যুর আগেও ধর্ষিত হয়েছিলেন। বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ভোরে যশোরে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। মুনিয়া ২-৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মৃত্যুর আগে তার পরনের জামাকাপড় ছেঁড়া হয়েছিল এবং তার শরীরে পুরুষের ডিএনএ মিলেছে।
রাজধানীর গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার (২২) বহুল আলোচিত রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় আদালতের নির্দেশে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা রেকর্ড হয়েছে।
মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এ মামলাটি (নম্বর-৫) দায়ের হওয়ার পর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ইউনিটের কাছে পাঠানো হয়েছে।ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ আদালতে মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে সোমবার এই মামলা করেন। এদিন দুপুরে নুসরাতের জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত।
ধর্ষণের পর হত্যার এই চাঞ্চল্যকর মামলায় প্রধান আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর (৪২)। পাশাপাশি তার বাবা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান (৭০), মা আফরোজা সোবহান (৬০), আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা (৪০), হুইপপুত্র শারুনের সাবেক স্ত্রী সাইফা রহমান মিম (৩৫), কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, পিয়াসার বান্ধবী ও ঘটনাস্থল গুলশানের ফ্ল্যাটমালিকের স্ত্রী শারমিন (৪০) ও তার স্বামী ইব্রাহিম আহমেদ রিপনকে (৪৭) আসামি করা হয়েছে।
ডাক্তারি পরীক্ষার বরাত দিয়ে ওই এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে এই কলেজছাত্রীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ৬ নম্বর আসামি সাইফা রহমান মিম ১ নম্বর আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের গার্লফ্রেন্ড ও ৭ নম্বর আসামি কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার (মাদকসহ গ্রেফতারের পর বর্তমানে কারাবন্দি) সঙ্গেও উক্ত আসামির বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। পিয়াসা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ভিকটিম মুনিয়াকে বিভিন্ন সময় ফোন করে আনভীরের সঙ্গ ত্যাগ করতে বলে এবং তার মাধ্যমেই ২ নম্বর আসামি আনভীরের মা আফরোজার কাছে ভিকটিম সম্পর্কে কুত্সা রটিয়ে হত্যার প্ররোচনা দেয়। এই পিয়াসার মাধ্যমেই মুনিয়াকে বসুন্ধরা এলাকার বাসায় ডেকে নিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে গ্রামের বাড়িতে যেতে বাধ্য করে প্রধান আসামির পরিবার।
বড় বোন নুসরাত মামলার এজাহারে বলেছেন, তার বোন মুনিয়ার মৃত্যুর পর যে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে; সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ভিকটিম ২/৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।’ এতে বলা হয়, মুনিয়া প্রতিদিন ডায়েরি লিখতেন। বাসায় তার লেখা চারটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। যাতে আসামি আনভীরের সঙ্গে মেলামেশা ও শারীরিক সম্পর্কের কথা তারিখ দিয়ে লেখা রয়েছে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুনিয়াকে ৬-৭ মাস ধর্ষণ করেছে আসামি আনভীর। এর শেষ পর্যায়ে ওই তরুণী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। বিষয়টি প্রকাশ পেলে ও বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় মুনিয়াকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র করে আসামিরা।
রহস্যঘেরা মৃত্যু মুনিয়ার :
গত ২৬ এপ্রিল রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ছিলেন কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মো. সফিকুর রহমানের ছোট মেয়ে। ঘটনার রাতেই বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন ওই তরুণীর বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। সেখানে বলা হয়, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সায়েম সোবহান আনভীর দীর্ঘদিন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন মুনিয়ার সঙ্গে। ওই বাসায় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কিন্তু বিয়ে না করে তিনি উল্টো মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন মুনিয়াকে।
পরবর্তীতে নুসরাত দাবি করেন, তার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে আনভীর। গত ১৯ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে গুলশান থানা পুলিশ জানায়, আসামির আনভীরের সঙ্গে ঘটনার সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হোক। এর বিরুদ্ধে আদালতে না-রাজি দেন বাদী নুসরাত। গত ১৮ আগস্ট পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণ করে ও বাদীর আবেদন খারিজ করে আসামিকে অব্যাহতি দেন ঢাকার সিএমএম আদালত।
মুনিয়ার অনভিরের ঝগড়ার ঘটনার দিন ২৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে মুনিয়া তার বড় বোন ও মামলার বাদী নুসরাতকে ফোন দিয়েছিল। মুনিয়া ফোনে নুসরাতকে বলে, ‘আপু আমার বিপদ, আনভীর আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। সে আমাকে বিয়ে করবে না। ভোগ করেছে মাত্র। তুমি তাড়াতাড়ি আসো, আমার বড় দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারে।’ আরো বলে, ‘আসার সময় ইফতারের জন্য কলা নিয়ে এসো।’
মুনিয়া ঢাকা থেকে পালাতে চেয়েছিলেন দাবি করে মামলার অভিযোগের চতুর্থ অংশে লেখা হয়, ভিকটিম ঘটনা আঁচ করতে পেরে আসামিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঢাকা ছেড়ে যশোর পালিয়ে যেতে চায়। এজন্য ঘটনার দিন ভোর ৫টায় ও সকাল ৭টায় বাড়িওয়ালী শারমিন ও তার স্বামী ইব্রাহিমের কাছে গাড়ি চেয়েছিল সে। তারা গাড়ি না দিয়ে বিষয়টি অপর আসামিদের নিকট ফাঁস করে দেয়। তখনই আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ভিকটিমকে বাসায় আটকে রেখে হত্যার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে এবং কিলিং মিশন দিয়ে ভিকটিমকে ধর্ষণোত্তর হত্যা করে আসামিরা তাদের সবার উদ্দেশ্য পূরণ করে।
মামলার এজাহারের ষষ্ঠ অংশের বিবরণে বলা হয়, মুনিয়াকে হত্যার দিন দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে ৫ নম্বর আসামি শারমিন বাদীকে ফোন করে বলে ‘তোমার বোনের কিছু হলে আমরা জানি না, তখন পুলিশ আসবে; মিডিয়া আসবে ইত্যাদি।’ অথচ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট মতে, ভিকটিমের মৃত্যু হয় দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে। এ ঘটনা প্রমাণ করে শারমিন মুনিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবগত ছিল এবং এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া বাদী ঘটনার তারিখ বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে কুমিল্লা থেকে ভিকটিমের দরজা বন্ধ দেখে বাড়িওয়ালা শারমিন ও তার স্বামী ইব্রাহিমের কাছে বাসার সংরক্ষিত চাবি চাইলে তারা ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসাবে চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চাবি না দিয়ে তালা ভেঙে বাসায় ঢোকার পরামর্শ দেয়।
অভিযোগের নবম অংশে বলা হয়, পুলিশ মুনিয়ার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। এতে ভিকটিমের যৌনাঙ্গে জখম ও রক্ত পরিলক্ষিত হয়। ভিকটিমের পরিধেয় বস্ত্র, অন্তর্বাস, পাজামা, কাটাছেঁড়া ছিল। যাতে প্রতীয়মান হয়, হত্যার পূর্বে ভিকটিমের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছিল ও ভিকটিম মুনিয়া ধর্ষিতা হয়েছিল।
অভিযোগের ১৪তম অংশে বলা হয়, ‘অত্র মামলার আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে ঘটনার তারিখ ভিকটিমকে বাসা থেকে পালানোর সুযোগ না দিয়ে বাসায় আটকে রেখে কিলিং মিশনের মাধ্যমে ভিকটিমকে ধর্ষণোত্তর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে সুকৌশলে ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দেয়ার জন্য ভিকটিমের লাশ ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। এজাহারের ১৬তম অংশে লেখা রয়েছে ‘তদন্ত রিপোর্টে ভিকটিমের সঙ্গে মৃত্যুর পূর্বে যৌন সম্পর্কের প্রমাণ মিলেছে, অর্থাৎ মুনিয়া মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষিত হয়েছে।
বড় বোন নুসরাত মামলার এজাহারে বলেছেন, তার বোন মুনিয়ার মৃত্যুর পর যে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে; সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ভিকটিম ২/৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।’ এতে বলা হয়, মুনিয়া প্রতিদিন ডায়েরি লিখতেন। বাসায় তার লেখা চারটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। যাতে আসামি আনভীরের সঙ্গে মেলামেশা ও শারীরিক সম্পর্কের কথা তারিখ দিয়ে লেখা রয়েছে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুনিয়াকে ৬-৭ মাস ধর্ষণ করেছে আসামি আনভীর। এর শেষ পর্যায়ে ওই তরুণী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। বিষয়টি প্রকাশ পেলে ও বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় মুনিয়াকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র করে আসামিরা।
মামলায় ১৭তম অংশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে বলা হয়, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ভিকটিমের হাতের লেখা ডায়েরি, মোবাইলসহ অন্যান্য মালামাল জব্দ করলেও রুমে পাওয়া রক্তমাখা জামা জব্দ করেনি। পরবর্তী ১৮তম অংশে বলা হয়, বাদী থানায় মামলা করতে গেলে কর্তৃপক্ষ বাদীর অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) (২)/৩০ ধারা এবং ৩০২/৩৪ ধারা উপাদান থাকা সত্ত্বেও উক্ত ধারায় মামলা রেকর্ড করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। পরবর্তীতে এক তরফা তদন্ত করে আসামিকে অব্যাহতি দেয় পুলিশ।