আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. এল.এ. কাদেরী ক্যান্সারে মারা গেছেন

নগর প্রতিবেদক :

ক্যান্সারেরর আক্রান্ত হয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউরোসার্জন ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এল.এ. কাদেরী না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ‘ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’।

রোববার (২৯ আগস্ট) বেলা ১১ টায় নগরের বেসরকারি সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় খ্যাতিমান এ চিকিৎসকের।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএম) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক খান।

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দিন ধরে কাদেরী স্যার অসুস্থ ছিলেন। উনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। ঢাকায় চিকিৎসা শেষে সিএসসআর হাসপালে চিকিৎসা নেন। সেখানেই বেলা ১১টায় তার মৃত্যু হয়। উনার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।’

উল্লেখ্য, অধ্যাপক ডা. এল.এ. কাদেরী ১৯৪১ সালের ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরীর ৩৪৫, নবাব সিরাজদৌল্লা রোডস্থ পৈত্রিক বাড়ীতে জন্ম গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম শহরেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫৯ সালে কৃতিত্বের সাথে আই এস সি পাশ করার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এম বি বি এস এ ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এম বি বি এস ফাইনাল পরীক্ষায় সারাদেশের মধ্যে স্বর্ণপদকসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

তা সত্ত্বেও সরকার বিরোধী ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে আইয়ুব-মোনায়েম সরকার তাঁকে স্কলারশিপ থেকে বঞ্চিত করেন এবং উচ্চ শিক্ষাতে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করে দেয় ৪ বছরের জন্য। এরপর ১৯৬৫ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে ১৯৬৮ সালের ২৯শে এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাউস সার্জন, সিনিয়র হাউস সার্জন ও ইমারজেন্সী মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।১৯৬৮ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উচ্চতর শিক্ষার জন্য ডা. এল.এ. কাদেরী লন্ডনে যান। সেখানে মেধার স্বাক্ষর রাখেন।

১৯৭৮ সালে অধ্যাপক ডা. এল.এ. কাদেরী তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের লিখিত অনুরোধে স্বদেশে ফিরে আসেন। সে সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পরবর্তীতে দেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুজদোজা চৌধুরী ঢাকার নিউরোসার্জারী বিভাগে যোগ দিতে বললে ডা. এল.এ. কাদেরী স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিউরোসার্জারী বিভাগ খোলার সুযোগ দিতে অনুরোধ জানান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই অনুরোধ রক্ষা করেন। সেই সময়েই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিউরোসার্জারী বিভাগ খোলা হয়। অধ্যাপক কাদেরী শুরু থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত এই বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউএসটিসি’র প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন।

সামাজিক দায়িত্ব ও পারস্পরিক সহমর্মিতার নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী অধ্যাপক ডা. এল.এ. কাদেরী বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বি এম এ) চট্টগ্রাম শাখার দু’বার নির্বাচিত সভাপতি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব সার্জনস্ এর সভাপতি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন’ এর কেন্দ্রীয় সভাপতি, বহুবার চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।

চিকিৎসা অবদানের জন্য মাদার তেরেসা স্বর্ণপদক ও মানবাধিকার শান্তিপদক পেয়ে সম্মানিত হন। বি এম এ সভাপতি থাকাকালীণ সময়ে ’৯০ সালে তিনি পেশাজীবী জনতার নেতা হিসেবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা রাখেন। সেই আন্দোলনে চট্টগ্রামের দু’সাহসী নেতা সাবেক মেয়র আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান তার পাশে ছিলেন।

এ ছাড়াও ডা. কাদেরী চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, ডায়াবেটিক সমিতি, কিডনি ফাউন্ডেশন, নাটাব, রোগীকল্যাণ সমিতি সহ বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠনের আজীবন সদস্য। তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পেশ করেন।১৯৭১ সালে লন্ডনে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন। লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নিয়ে ‘‘বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন” নামে সংগঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।এল.এ. কাদেরীর পিতা মরহুম আবদুল লতিফ উকিল ছিলেন বৃট্রিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে স্বাধীণতা সংগ্রামী। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির প্রথম মুসলিম সভাপতি, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, চট্টগ্রাম শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী শাসকচক্রের বিভিন্ন গণবিরোধী পদক্ষেপে তিনি প্রতিবাদ করেন এবং গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

আবদুল লতিফ উকিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৯ সালে লালিদিঘীর মাঠে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের প্রথম জনসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। ঐ জনসভায় তৎকালীন সরকার সমর্থক গুন্ডারা হামলা চালালে আবদুল লতিফ উকিলের মাথা ফেটে রক্ত ঝরে।

আওয়ামী লীগের ইতিহাসে দলের জন্য ওই প্রথম রক্ত ঝরে আবদুল লতিফ উকিলের মাথা থেকেই। তিনি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-সমবায় সংগঠন-বিভিন্ন পীর-আউলিয়া দরগাহ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও সম্পাদক হিসেবে সর্ব অবস্থায় নিঃস্বার্থ খেদমত করে জনগণের এবং সহকর্মী ও অনুবর্তীদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আনুগত্য সমানে পেয়েছেন।ডা. এল.এ. কাদেরী মা মরহুমা আনোয়ারা বেগম ছিলেন মোহরারর পীরে কামেল হযরত মাওলানা নূর আহমদ আল কাদেরী (র.) এর কন্যা। হযরত মাওলানা ১৯৪৩ সালে ওফাত হন। মরহুম আনোয়ারা বেগম দানশীল ও সংগঠক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সময় সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে তাকে পরিষদ সদস্য পদ গ্রহণের প্রস্তাব করলে পর্দার ব্যাঘাত হওয়ার আশংকায় তিনি ঐ প্রস্তাব পরিত্যাগ করেছিলেন। এল.এ. কাদেরীর দাদা মরহুম মুন্সী রহমান আলী বাংলা, পার্সি, আরবী, ইংরেজী, উর্দ সহ কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। সে সময় তিনি বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে ব্যবসা করতেন।ডা. এল.এ. কাদেরীর পরিবার খুবই ছোট। স্ত্রী সুরাইয়া কাদেরী রতœগর্ভা। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় এম এ পাশ করেন। তিনি ইনার হুইল ক্লাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বর্তমানে হাইকেয়ার স্কুল ও হিয়ারিং সেন্টারের ডিরেক্টর, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি ও চট্টগ্রাম কিডনি ফাউন্ডেশনের আজীবন সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন সমাজসেবকমূলক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। তাছাড়াও তিনি গরীব-দুঃখী মানুষের আপনজন হিসেবে খ্যাত। একমাত্র কন্যা ড. সোনিয়া কাদেরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Applied Physics এ স্বর্ণপদক সহ এম এস সি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। বর্তমানে স্বামী ইঞ্জিনিয়ার জাফরউল্ল্যাহ আরিফ লিটনসহ আমেরিকায় বসবাস করছেন।

একমাত্র পুত্র ইঞ্জিনিয়ার রিয়াদ কাদেরী বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর বিলাতের মানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এস. ডিগ্রী নেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে কর্মরত এবং স্ত্রী ডা. ফারজানা নাজনীন সহ সেখানে বসবাস করছেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউরোসার্জন ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এল.এ. কাদেরীর মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হবার পর মেডিকেল পাড়ার শোকের ছায়া বিরাজ করছে।