পিবিআইয়ের চার্জশিট: পটিয়ার সোহেল হত্যা মামলায় কায়েছ সহ ৯ জন নিরপরাধ

পটিয়া প্রতিনিধি:

চট্টগ্রামের পটিয়ায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার জেরে মোহাম্মদ সোহেল (৩৬) খুনের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন আইনে করা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

সোহেল হত্যা মামলার ৯ আসামিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উল্টো ঘটনায় তাদের জড়িত না থাকার বিষয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে পিবিআই জানিয়েছে।

চার্জশিট থেকে বাদ ৯ ‘নিরপরাধ’ ব্যক্তি হলেন- মো. কায়েছ, মো. সুমন, জাহাঙ্গীর আলম, জসীমুল আনোয়ার খান, গাজী আজগর আলী, আলী আহমদ, আবদুল কাদের খান, তারেকুর রহমান রিয়াদ ও তৌহিদুল ইসলাম।

উক্ত হত্যা মামলার চার্জশিটে এজাহারভুক্ত আসামি মো. শরিফ, তার বাবা মো. মনসুর, মা নুর আয়েশা ও খালা জোবাইদা আকতারকে আসামি রাখা হয়েছে।

গত ১৪ মে চার্জশিটটি আদালতে দাখিল করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ পরিদর্শক মো. বাবুল আকতার।

এই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি, যার ছুরিকাঘাতে সোহেল নিহত হয়েছেন সেই মো. শরিফ ঘটনার পর থেকে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন।

নিহত মোহাম্মদ সোহেল আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান কাশিয়াইশ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের ছোট ভাই এবং কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের ভাগ্নে।

অপরদিকে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন আইনে দায়ের করা আইনে চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের করা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআই। ফলে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পেতে যাচ্ছেন এজাহারভুক্ত আসামি মো. কায়েছ, জসীমুল আনোয়ার খান, এম সালাউদ্দীন তালাশ, ইউপি সদস্য গাজী মোহাম্মদ আলী, আরিফ মঈনুদ্দিন প্রকাশ রাসেল, মো. এরফান ও আহমদ নুরকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে; এ মামলায় জসীমুল আনোয়ার খান, এম সালাউদ্দীন তালাশ ও আরিফ মঈনুদ্দিন রাসেল কারাগারে গিয়েছিলেন।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই পরিদর্শক মোহাম্মদ মুনির হোসেন বলেন, বাদী যে ধারায় এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন সেই ধারাটি ২০০২ সালে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এ মামলাটি আর ঠিকবে না। এ কারণে সব আসামির নাম বাদ দিয়ে মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

এর আগে সোহেল হত্যা মামলা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন আইনে দায়ের করা মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। গত বছরের ১৩ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সই করা এক চিঠিতে পটিয়া থানার এ দুটি মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দেওয়া হয়। তখন থেকেই এ দুই মামলার দায়িত্ব পটিয়া থানা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নেন পিবিআইয়ের দুই পরিদর্শক।

অভিযোগ ছিল, পটিয়া থানা পুলিশ একতরফাভাবে এই দুটি মামলা রেকর্ড করে চেয়ারম্যানের পক্ষে কাজ করছে। অভিযোগটি আসার প্রেক্ষাপটে তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইকে দেওয়া হয়েছিল।প্রসঙ্গত, গত বছরের ২২ এপ্রিল উপজেলার কাশিয়াইশ ইউনিয়নের বুধপুরা বাজারে ইউপি নির্বাচনের জের ধরে স্থানীয় মো. শরিফ নামের এক যুবককে কাশেম চেয়ারম্যানের লোকজন মারধর করেন। এর জের ধরে সেদিন রাতে ক্ষিপ্ত হয়ে শরিফ ছুরিকাঘাত করেন সোহেলকে। এসময় গুরুতর আহত অবস্থায় সোহেলকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর মারামারি, ভাঙচুর, মামলা-পাল্টা মামলায় আতঙ্কে দিন কাটে বুধপুরা এলাকাবাসীর। একপক্ষ অপরপক্ষকে ঘায়েল করতে একেক পন্থা অবলম্বন করছিল। সেই সময় মামলায় কখন কে আসামি হয়ে যায় বা হামলার শিকার হন, এ ভয়ে দিন কাটে সবার।

অপরদিকে, কাশিয়াইশ ইউনিয়ন পরিষদের সম্মুখে তৎকালীন নির্মিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ঢেকে দেওয়া ত্রিপলে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে, গত বছরের ২১মে রাতে। এ ঘটনায় কাশিয়াইশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের দায়েরকৃত মামলায় ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন কাশিয়াইশ ইউনিয়নের জলিল আহমদের পুত্র সালাউদ্দিন তালাশ (৪০) ও মৃত আবদুস সালামের পুত্র আরিফ মাঈনুদ্দিন রাসেল (৩৮)।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের রেশ ধরে কাশিয়াইশ ইউনিয়নে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সেই বছরের নির্বাচনের দুই মাস আগে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে আগুন ও দারোয়ানকে মারধরের ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল পটিয়া থানায়। পরবর্তীতে ওই মারধরের অভিযোগে শরীফসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। যদিও ঘটনাস্থল ১নং ওয়ার্ডে হলেও সেই মামলার বাদি হন ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও কাশেম চেয়ারম্যানের বডিগার্ড আশীষ দাশ।

অন্যদিকে, গত বছরের ২২ এপ্রিল রাতে দুর্বুত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন কাশিয়াইশ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মোহাম্মদ সোহেল। এসময় আরও তিন জন চুরিকাঘাতে আহত হন। তবে সেদিন বুধপুরা বাজারের ঘটনাস্থলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও রহসজনকভাবে ফুটেজ না দেখেই পটিয়া থানা পুলিশ চেয়ারম্যানের কথামত মামলা রেকর্ড করে বলে অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনাও হয়।

এদিন সোহেল নিহত হওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তার স্বজন ও চেয়ারম্যানের লোকজন বুধপুরা বাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ কাইছের বাড়ি ও তার সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ উঠে।অভিযোগ ‍আছে, পটিয়া থানার তৎকালীন একজন উপ-পরিদর্শক কাশিয়াইশ ইউনিয়নের চৌকিদার আবদুস ছাত্তার ও দফাদার বিপ্লব দাশকে ধরে নিয়ে থানায় আটকে রেখে মামলার বাদী বা সাক্ষী হতে চাপ সৃষ্টি করেন।

এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী চৌকিদার আবদুস ছাত্তার ও দফাদার বিপ্লব দাশ গত বছরের ২৭ মার্চ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন ও তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন।লিখিত দুটি অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন, গত ২৬ মার্চ রাতে পটিয়া থানার উপ-পরিদর্শক নুরুল আমিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমাদেরকে জোরপূর্বক আটক করে থানায় নিয়ে যান।

এসময় তিনি আমাদেরকে চাপ সৃষ্টি করে বলেন চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বুধপুরা গ্রামের কিছু ব্যাক্তির বিরুদ্ধে মামলা করবে। এ মামলায় চেয়ারম্যানের পক্ষে সাক্ষী হতে হবে। অন্যথাই তোমাদেরকে মামলায় জড়িয়ে চালান করে দেওয়া হবে।

এসময় তারা কোনো মামলায় সাক্ষী অথবা বাদী হতে পারবেন না বললে তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে সারারাত থানায় আটকে রাখা হয়। পরদিন সকালে বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকার লোকজন ও স্থানীয় ইউপি সদস্য গাজী মোহাম্মদ আলীসহ থানায় যোগাযোগ করলে ২৭ মার্চ সকাল ১১ টার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বলে দেওয়া হয়, কোথাও এ ব্যাপারে মুখ না খুলতে। এ ঘটনার পর থেকেই তারা অজানা আশংকায় এবং চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে লিখিত অভিযোগ উল্লেখ করেছেন কাশিয়াইশ ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার আবদুস ছাত্তার ও দফাদার বিপ্লব দাশ।

দুই মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে যাওয়া ব্যবসায়ী জসীমুল আনোয়ার খান বলেন, ‘এ ঘটনার সাথে আমি কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলাম না। গত ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. কায়েছের পক্ষে কাজ করার জের ধরে আমাকে মামলাগুলোতে জড়ানো হয়েছে। মামলার পর থেকেই পটিয়া থানার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সবার উপর আস্থা ছিল না। তাই আমরা মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম পুলিশ সদরদপ্তরে। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়েছে। পিবিআই তদন্ত সাপেক্ষে নির্দোষ ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে আর দোষীদের শনাক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।’