‘কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষা অপেশাদার আচরণ’ – সাংবাদিক ফেরদৌস শিপন

সাংবাদিক ফেরদৌস শিপন এর ফেসবুক ওয়াল থেকে :

কেবলমাত্র সরকার কতৃক অনুমতিপ্রাপ্ত সংবাদপত্র আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে কর্মরতরাই সাংবাদিক। তাঁরাই চরিত্রবান। আর আইপি টিভি কিংবা অনলাইন সংবাদপত্রগুলোই ভুঁইফোঁড় কথাটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত তার মানদন্ডে এখন যাবো না। তবে দেশের যেকোনো গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের প্রতি আমার আকুল আবেদন, যেই সংবাদ মাধ্যমেই হোক মানুষ বিব্রতবোধ করে এমন সংবাদ প্রকাশ কিংবা প্রচার থেকে বিরত থাকুন। শুধু ভিত্তিহীন, আক্রমণাত্নক, মিথ্যা সংবাদ উপস্থাপন বা পরিবেশন করে অনাকাঙ্ক্ষিত আর অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না। অনৈতিক সাংবাদিকতার চর্চা সাংবাদিকতার নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং একজন সংবাদকর্মী তার নিজের সংবাদ পরিবেশন করার আগে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত, সংবাদটি নীতিনৈতিকতায় কতটুকু নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। সেটি আগে নিজে যাচাই করুন, তারপর গণমাধ্যমে প্রচার করুন।

প্রতীকী ছবি


আমার সৌভাগ্যই বলা চলে, সাংবাদিকতায় তিনটি সেক্টরে (প্রিন্ট লাইন, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং অনলাইন মিডিয়া) কাজ করার খুব সামান্যতম হলেও অভিজ্ঞতা আছে। আজকাল দেখি আমার কিছু সংবাদকর্মীবন্ধু, সহযোদ্ধা-সহকর্মী নিজের চরকায় তেল না দিয়ে অনলাইন সাংবাদিকতা নিয়ে চুলকানি শুরু করেছেন। আমি মনে করি, যা ব্যাক্তিগত ঈর্ষার প্রতিফলন। নয়তো কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তাছাড়া কিছু কিছু প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক অপেশাদার হয়েও নিজে পেশাদার সাংবাদিক দাবি করে আজকাল নিজেকে অনেক ক্ষমতাধর ভাবেন। কোন সভা-সমাবেশ, সেমিনারে অনলাইন মিডিয়ায় কর্মরতদের দেখলে তাঁদের চুলকানির মাত্রা বেড়ে যায়। তাদের স্বভাব চরিত্রে এমন ভাব প্রকাশ পায় যেন, কোন বাহিনী কিংবা সরকারি উচ্চ পর্যায় থেকে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ অনলাইন মিডিয়া নিয়ে ‘সুড়সুড়ির কনটেন্ট’ বানিয়ে নিজেদের সাধু সাজানোর চেষ্টায় মত্ত রয়েছেন। আসলেই কি তা! সম্প্রতি সে ধরণের একটি তথাকথিত সুড়সুড়ির কনটেন্ট নিয়ে চট্টগ্রামের মিডিয়া পাড়ায় ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলতে শোনা যায়। যেখানে বলা হয়, অনলাইন সংবাদপত্র ভুঁইফোঁড় আর সেখানে কর্মরত সাংবাদিকরা চাঁদাবাজ! আর দেশের সকল স্যাটেলাইট চ্যানেল বৈধ আর সুষ্ঠু সংবাদ পরিবেশন করে আসছে।

হাস্যকর ব্যাখ্যাটি হার মানিয়েছে অভিনেতা হিরো আলমের বানানো কনটেন্টকেও। তবে হ্যাঁ, মানুষ হাসানো হলেও ‘সাধু সাবধান’। মূলতঃ সাংবাদিকতায় যারা সুড়সুড়ির কনটেন্ট বানিয়ে প্রচার করে তারা নিজেরা কতটুকু স্বচ্ছতা এবং নীতিনৈতিকতা ধরে রাখতে পারছেন তা চিন্তা করে দেখুন। ‘সুড়সুড়ির’ কনটেন্ট কিংবা ক্লিক-বেইট জার্নালিজমের আওতায় নিজের মনগড়া করা রিপোর্টটি পড়ছে কি-না!


অনলাইন সাংবাদিকতায় যাদের সুড়সুড়ি আছে তারা আসুন, আপনাদের অন্ধত্ব, বধিরত্ব থেকে টেনে এনে আলো এবং সম্ভাবনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। দৈনিক ‘প্রথম আলোর’ সাথে দৈনিক নামসর্বস্ব পত্রিকা ও বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির সাথে নামসর্বস্ব আরেকটি বেসরকারি টেলিভিশনের তুলনা করতে পারেন না। আবার দুটি পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেলই বৈধ, এবং সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত। তেমনটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমেও রয়েছে। যার জন্য নীতিমালা তৈরি করে সরকার ক্রমান্বয়ে অনলাইন সংবাদপত্রের অনুমোদন প্রদান করে আসছেন। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, দেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের পাঠক দিন দিন বাড়ছে। ইন্টারঅ্যাকটিভিটির সহায়তায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে খবর, ফিচার ও পাঠ্য বিষয় যখন অডিও এবং ভিডিও আকারে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে আমরা অনলাইন বা ডিজিটাল সাংবাদিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করি। অনলাইন সংবাদপত্র ট্র্যাডিশনাল সংবাদপত্রের মতো সংবাদের সাথে ফিচার, ছবি, অডিও, ভিডিও প্রকাশ করে এবং যে কেউ লেখা বা মতামত পাঠাতে চাইলে পাঠক সহজেই তার মতামত জানাতে পারেন। ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি বস্তুত অনলাইন সাংবাদিকতার ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল। অর্থাৎ ইন্টারনেটের ভূমিকা স্রেফ হকারের ভূমিকা মাত্র। সংবাদপত্রের জন্য যেমন হকার রয়েছে, টেলিভিশনের জন্য রয়েছে কেবল অপারেটর। তেমনি অনলাইন সংবাদপত্রের জন্য রয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার।


বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে। দেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪.কম। বিশিষ্ট সাংবাদিক আলমগীর হোসেন ছিলেন এর প্রধান সম্পাদক ও অন্যতম উদ্যোক্তা। আধুনিক এই যুগে পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘটনা ঘটুক না কেন, তা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের নাগালে চলে আসছে। সেই খবর তখনই পাঠকের জন্য পরিবেশন করা হচ্ছে। এই গোটা প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে অনলাইন পত্রিকা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, অনলাইন সাংবাদিকতা। আর সরকার যখন ধাপে ধাপে সেই ডিজিটাল বাংলাদেশে উন্নতি হচ্ছে তখনি সংবাদ মাধ্যমে ঘাপটি মারা একটি চক্র তা নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাদের তথাকথিত চরিত্রে ফুটে উঠেছে মৌলবাদের আসল লেবাস। তারা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়নমুখী কাজে বাঁধাগ্রস্থ করছে। অথচ ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তিতে জনগণের প্রবেশাধিকার এবং ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে।

২০১০ সাল নাগাদ শেখ হাসিনার সরকার তার নির্বাচনি ইশতেহার মেনে নিজেকে ডিজিটাল সরকার ঘোষণা করে। তারই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য গনমাধ্যমের মতো অনলাইন সংবাদপত্রেরও নীতিমালা তৈরি করে অনুমোদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন।
আমার জানা মতে, বিডিনিউজ২৪.কম-এর ধারাবাহিকতায় দেশে একের পর এক এলো সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক নিউজপোর্টাল। এসেছে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, বাংলাট্রিবিউন.কম, সারাবাংলা.কম সহ অসংখ্য অনলাইন সংবাদমাধ্যম। আর দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলোর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, সমকাল, সংবাদ, চট্টগ্রাম এর প্রথম সারির দৈনিক আজাদী, দৈনিক পু্র্বকোন সব সংবাদপত্রেরই রয়েছে অনলাইন ভার্সন। এখন দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেলেরও অনলাইন ভার্সন রয়েছে। এসব দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন ভার্সনের অনুমোদন কখন পেয়েছে জানেন? কিন্তু তার আগে কি তারা তাদের অনলাইনে পোর্টালে সংবাদ কিংবা ভিডিও কনটেন্ট প্রচার করেননি?

সাংবাদিকতার চর্চা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই বেশি হচ্ছে। আমাদের আর পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। অনলাইন সংবাদমাধ্যমেই আসছে ভরসা। তবুও বলতে হয়, আমরা যে যেখানে থাকি (প্রিন্ট, ইলেক্টনিক ও অনলাইন মিডিয়া) সে সেখানকারই লোক হই, কিংবা হয়ে যাই। এসবে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের আরেকটি স্বভাব খুব করে রয়েছে, অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। একটু কঠোর ভাষায় বলতে গেলে ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে যখন আমরা জ্ঞান রাখি না তখনই ওইসব প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ প্রয়োগ করে নিজেকে খুব জাহির করার চেষ্টা করি। নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে অন্যকে হেয় করতেও দ্বিধা করি না। এতে নিজের দৈন্যই স্পষ্ট হয়। নানা কারণে সমাজে অগ্রসর বলে সমাদৃত, তারা যখন মিডিয়া সাক্ষরতার জ্ঞানহীনতায় ভোগেন, তখন হতাশা তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে- অনলাইন সংবাদপত্রকে খাটো করে দেখা কোনো কাজের কথা নয়। এখানেও সাংবাদিকতার চর্চা চলে, সাংবাদিকতার সব নীতি-নৈতিকতা মেনেই চলে। কেবল মাধ্যমটি ভিন্ন। বর্তমান বিশ্বে অনলাইন সাংবাদিকতা সবচেয়ে স্মার্ট পেশা। তাই বলে কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষা একটি অপেশাদার আচরণ বলে মনে করি।
#

(বিঃ দ্রঃ- এটি আমার সম্পুর্ন নিজস্ব মতামত। কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত বা কাউকে ব্যাক্তিগতভাবে হেয় করার জন্য না। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

ফেরদৌস শিপন

সম্পাদক, বাংলাধারা ডটকম।