নাটকে ভাল বাজেট, ভাল গল্প ও চিত্রনাট্য নির্বাচনে নীতিমালা থাকা উচিৎ!

সম্পাদকীয়:

মোরশেদ হিমাদ্রী হিমু একাধারে একজন অভিনেতা, আলোকচিত্রী, নাটক ও শর্টফিল্ম নির্মাতা ও পরিচালক। সম্প্রতি নির্মাণ করছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘একটি খুনের বিবরণ’। বর্তমানে হিমু নিয়মিত নাটক ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। বর্তমানে মোরশেদ হিমাদ্রী হিমু নতুন চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করছেন। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা রয়েছে। সম্প্রতি শেষ করেছেন নাজমুস সাকিবের গল্প ও জোনায়েদ রশিদের চিত্রনাট্যে থ্রিলার ধর্মীটিভি নাটক ‘দ্য ডে অব মেরিজ এ্যানিভার্সারি।’

খুব শিগগিই বেসরকারী একটি টিভি চ্যানেলে প্রচারের অপেক্ষায় আছে নাটকটি।

নির্মাতা হিসেবে নিজের শুরুর গল্পটা জানালেন তিনি। ‘১৯৯৫ সালে এইচএসসি পাশ করার পর প্রতিভাস নাট্যদলের সাথে মঞ্চে কাজের সুযোগ তৈরি হয়। অভিনয় করেছি কিনুকাহারের থেটার, কোর্ট মার্শাল, জায়া প্রজায়িনী, চাঁদ বনিকের পালা, চোপ আদালত চলছে নাটকে। তবে অভিনয়ের চাইতে মঞ্চের পেছনের কাজ যেমন লাইট ডিজাইন, সেট নির্মাণ, প্রোডাকশন ইত্যাদির প্রতি আগ্রহটা ছিল বেশী।

পাশাপাশি ফটোগ্রাফি করতাম শখের বসে। এক সময় মঞ্চের অভিনয় আর আলো ছায়ায়ই হয়ে উঠে আমার ফটোগ্রাফির সাবজেক্ট। মঞ্চ নাটকের আলোকচিত্র নিয়ে আমার একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয় দুইটি- ‘পয়েজি অব প্লে’ ও ‘আলোছায়ায় বাংলাদেশের নাটক’।

এখনো মঞ্চ নাটকের ছবি তুলে যাচ্ছি। স্থিরচিত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এক সময় চলচ্চিত্রের সখ পেয়ে বসে আমাকে। ২০০৮ এর দিকে বন্ধু ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রফিকুল আনোয়ার রাসেলের অনুপ্রেরনায় চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হই ও ২০১৩তে ‘স্বপ্নের শিখরে হলুদ কোলাজ’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে আমার যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী ২০১৪-তে টিভি নাটক নির্মানের কাজ শুরু করি।

এনটিভি, আরটিভি, মাছরাঙাতে এখনো পর্যন্তু প্রচারিত উল্লেখযোগ্য নাটাকের মধ্যে আছে আবর্তন, শুভ্র ও জোছনার গল্প, তোমার চিবুক ছোঁব কালিমা ছোঁবনা, মিথিলা, শীলার গল্প, চোর, তবুও ভোর হয়, ছায়া শিকারী, পরী ইত্যাদি। এ পর্যন্ত নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা পাঁচটি- স্বপ্নের শিখরে হলুদ কোলাজ, তাড়া, গুম, বাইশ বছর পরে ও একটি খুনের বিবরণ।’

মোরশেদ হিমাদ্রী হিমুর মতে, যে কোন কাজেই কম-বেশী সীমাবদ্ধতা থাকে। তবে, আমার মনে হয়, টিভি নাটকে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হল বাজেট। বাজেট কম থাকায় একটা ভাল গল্পকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে শিল্পী নির্বাচন, নির্মাণের সময়, টেকনোলজিসহ নির্মাণের প্রতিটা স্তরেই নির্মাতাকে অনেক বেশী কম্প্রোমাইজ করতে হয়। ফলে মানসম্মত নাটক তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সীমাবদ্ধতার আরেক দিক বললে বলতে হয়, ভাল চিত্রনাট্যের অভাব। নাটক বা চলচ্চিত্রের মূল বিষয় হল- চিত্রনাট্যের মাধ্যমে গল্পটা দর্শককে উপস্থাপন যেখান থেকে দর্শক তার বাস্তবজীবনের মিল খুঁজে পাবে। ভাল চিত্রনাট্যের অভাবে ভাল গল্প বলা হয়ে উঠছে না। ফলে গল্পের মূল বিষয়বস্তু থেকে সরে এসে এর চাকচিক্যই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশী। ইদানিং অসৎ এক শ্রেণির প্লাটফর্ম সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সস্তা জনপ্রিয়তা, চাকচিক্যের লোভে নাটক বা চলচ্চিত্রকে তাদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পরিণত করায় নানা রকম রুচিহীন কন্টেন্ট তৈরি করছে; যা পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

ফলে রুচিশীল দর্শকরা নাটক দেখায় আগ্রহ হারাচ্ছেন এতে করে আমরা আমাদের নিজস্ব শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের গল্পও হারাতে বসেছি। তবে ভাল দিক হল- বর্তমানে বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের দর্শকরা এখন নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, ইউটিউবসহ নানা প্লাটফর্মে পৃথিবী বিখ্যাত নাটক, চলচ্চিত্র দেখে অভ্যস্থ হচ্ছেন ও তাদের রুচিরও পরিবর্তন হচ্ছে। ভাল কন্টেন্টের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে।

এ বিষয়টি চিন্তায় রেখে আমাদের নিজেদের সচেতনতার পাশাপাশি টিভি চ্যানেলগুলোরও নাটক নির্মাণে পর্যাপ্ত বাজেট নির্ধারণ, ভাল গল্প ও চিত্রনাট্য নির্বাচন ও প্রচারের ক্ষেত্রে নীতিমালা নির্ধারণের পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ; যা নির্মাতা বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভুমিকা রাখবে। অনেক বেসরকারী টিভি চ্যানেল ইতিমধ্যে পদক্ষেপও নিয়েছে। পাশাপাশি আমাদের দেশের ওটিটি প্লাটফর্মগুলোও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভুমিকা রাখছে। ওটিটির অনেক নাটক, চলচ্চিত্র বর্তমানে দর্শক হৃদয় জয় করছে। এর পেছনে ভাল বাজেটের পাশাপাশি ভাল নির্মাণশৈলীও বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

ফলে আমাদেও দেশের অনেক ভাল নাটক, চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ বিদেশে প্রশংসা পাচ্ছে। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য ইতিবাচক দিক।’ চট্টগ্রামের এ নির্মাতা ঢাকা ভিত্তিক নাটক নির্মাণ করলেও বর্তমানে নিজ জেলার দিকে নজর দিতে চান।

তিনি বলেন, ‘বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নাটক বা চলচ্চিত্রে আমরা শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা বা চটুল বিষয়কে হালকাভাবে উপস্থাপন করে বিনোদন পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সমস্যা, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা ঘটনা বা গল্পগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। হাজার বছরের ইতিহাস চট্টগ্রামের। আঞ্চলিতকতা শুধুমাত্র তো ভাষা দিয়ে নির্ণয় করা হয় না। ভাষার পাশাপাশি এর প্রতিটি স্তরেই রয়েছে নানা জনপদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির গল্প।

আমি মনে করি, নাটক বা চলচ্চিত্র যেহেতু দেশ, জাতি বা গোষ্টির আত্মপরিচয়ের একটা শক্তিশালী মাধ্যম। তাই এর মাধ্যমে আঞ্চলিকতার শুধুমাত্র হালকা, চটুলতাকে প্রাধান্য না দিয়ে জনপদের নানান গল্প উঠে আশা দরকার। আমি আমার নির্মাণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অভিনয়শিল্পীদের সাথে নিয়ে এখানকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গল্প বলার চেষ্টা করছি এবং এ চেষ্টা সব সময়ই অব্যহত থাকবে- আশা রাখছি।

চট্টগ্রামে টিভি নাটকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মোরশেদ হিমাদ্রী হিমু বলেন, ‘যে কোন সেক্টরেই পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ না থাকলে এর ভবিষ্যৎ ভার হতে পারে না। শুধুমাত্র একটি আঞ্চলিক টিভি স্টেশনকে কেন্দ্র করে টিভি নাটকের ভবিষ্যৎ চিন্তা করাটা ভুল। যে জায়গায় যত প্রতিযোগীতা, সেখানে কাজের মান ততই উন্নত- এটাই স্বাভাবিক। নাটক ও চলচ্চিত্রসহ পুরো মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি যেহেতু রাজধানী কেন্দ্রিক, তাই স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার অভিনয়শিল্পীসহ কলাকুশলীদের অগ্রাধিকার থাকে এবং তারা সহজেই এ ইন্ডাস্ট্রিকেই তাদের পেশাগত প্লাটফর্ম হিসেবে বেছে নিতে পারছেন।

চট্টগ্রামে এখনো কোন মিডিয়া ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে উঠে নি; ফলে এখানে কাজের ক্ষেত্র নেই বল্লেই চলে। তাই চট্টগ্রামের শিল্পীদের যথেষ্ট যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকা সত্বেও পেশাগত দিক থেকে মিডিয়া ইন্ডাষ্ট্রিতে ঢাকার শিল্পীদের তুলনায় পিছিয়ে আছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শুধু নাটক বা চলচ্চিত্র ছাড়াও শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমেও যে সব শিল্পী ও কলাকুশলীরা আজকে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করছেন; তাদের অনেকেই চট্টগ্রামের ও তারা পেশাগত খাতিরে অনেক আগেই ঢাকায় থিতু হয়েছেন এবং যোগ্যতার সাথেই কাজ করে যাচ্ছেন।

চট্টগ্রামের একজন ছাত্র সরকারী বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করে যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্তে¡ও পেশাগত কারণে তাকে ঢাকামুখীই হতে হচ্ছে। তাই, এ ক্ষেত্রে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মত চট্টগ্রামে মানসম্মত মিডিয়া নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা জরুরী। তবেই এর ভাল ভবিষ্যৎ আশা করা যায়।