চট্টলা ডেস্ক:
আজ মহালয়া। গুরুগম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়েই দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা শুরু। সনাতন হিন্দু ধর্মমতে, দুগর্তিনাশিনী মা দুর্গার মর্ত্যে আগমনের এই দিনটিতে ধরায় শুরু হয় দেবীপক্ষ। আর দেবীকে বরণ করে নেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। মহামায়া দুর্গার সব সময়ের বাহন সিংহ হলেও মর্ত্যলোকে গমনাগমনের সময় তিনি ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনের আশ্রয় নেন। এবার দেবী এসেছেন ঘোড়ায় চেপে।
ধর্মশাস্ত্র মতে, মর্ত্যে দেবীর এই গমনাগমনের যে বাহন, তার রকমফেরের ওপর পৃথিবীর শুভ-অশুভ নির্ধারিত হয়। দেবী দুর্গার বাহনের মধ্যে রয়েছে গজ (হাতি), ঘোটক (ঘোড়া), নৌকা ও দোলা। ঘোড়ায় চেপে দেবীর গমনাগমনে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে, এমনই ইঙ্গিত বহন করে হিন্দু শাস্ত্র।সারা দেশে নানা আয়োজনে উদযাপন হয়েছে শুভ মহালয়া।
চণ্ডীপাঠ ও বন্দনা গীতির মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভক্তরা। অশুভ শক্তির বিনাশ আর শুভ শক্তির উদয়ের প্রার্থনা তাদের। একইসাথে মহামারি কাটিয়ে সুন্দর পৃথিবীর প্রার্থনা সবার। শুভ মহালয়া উদযাপনে ভোর থেকেই বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপে ভিড় করেন সনাতন ধর্মালম্বীরা। হিন্দুধর্ম মতে, দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে পূজিত হন শরৎ ও বসন্তকালে। তবে এই দুই কালের রূপ ভিন্ন। শরতে তিনি দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এবং বসন্তকালে বাসন্তী রূপে আবির্ভূত হন।
কখনও তিনি গজে, কখনওবা ঘোটকে, কখনও দোলায়, আবার কখনও নৌকায় গমনাগমন করেন। শাস্ত্রমতে, গমনাগমনের বার ও তিথীর ওপর ভিত্তি করে বাহন নির্ধারণ হয়। দেবীর গমনাগমন যদি রোববার বা সোমবার হয় তাহলে তার বাহন হয় গজ। আবার দেবীর গমনাগমন যদি শনিবার বা মঙ্গলবার হয় তিনি চড়েন ঘোটকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার যদি দেবী আসা-যাওয়া করেন তাহলে তিনি দোলায় চড়েন। আর বুধবার হলে তার যাতায়াতের যানবাহন হয় নৌকা।
শাস্ত্র বলে- ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’। অর্থাৎ দেবী যদি গজে গমনাগমন করেন তাহলে পৃথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে এবং শস্যর ফলন ভালো হয়। সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ থাকে মর্ত্যভূমি। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই শাস্ত্রে। তবে পার্থিব সম্পদের মধ্যে ‘গজ’ হলো বড় সম্পদ। প্রাচীনকালে রাজা মহারাজাদের বৈভব মাপা হত হাতিশালের হাতির সংখ্যা বিচার করে। তাই ‘গ’ সমৃদ্ধির প্রতীক। অন্যদিকে, হাতি হল অন্নপূর্ণা এবং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার বাহন। অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে এই বসুন্ধরা।
দেশের বিভিন্ন মন্দিরে চণ্ডীপাঠ ও বন্দনা গীতির মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভক্তরা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন মন্দিরে ভোরে চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহালয়ার আয়োজন। করোনা মহামারি থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার প্রার্থনায় রত হন ভক্তরা।‘দোলাং মড়কাং ভবেৎ’। অর্থাৎ দেবী দুর্গা যদি দোলায় চড়ে গমনাগমন করলে পৃথিবীতে অনেক মৃত্যু দেখা যাবে। এই মৃত্যু হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কিংবা যুদ্ধের হানাহানিতে। দোলা হলো পালকির মতো একটি যান। যার স্থিরতা কম, সব সময় দোদুল্যমান, অল্পে ভঙ্গুর এবং অনেক সময়ই বিপদের কারণ।
তাই দুর্গার দোলায় গমনাগমনে মর্তের স্থিরতা ব্যাহত হতে পারে। দুর্গা যদি বৃহস্পতি বা শুক্রবার গমনাগমন করেন, তাহলে তার যানবাহন হয় দোলা। বলা হয়- দেবগুরু বৃহস্পতি হলেন বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং চিন্তাশীল। ফলে ভবিষ্যতের ভালোমন্দ ভাবতে ভাবতে তিনি এতটাই বিভোর হয়ে পড়েন যে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নিয়ে নেন। শাস্ত্র বলে, অতি বিলম্বের ফল ভালো হয় না।দেবী দুর্গার গমনাগমন ঘোটকে হলে চরম বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষয়ক্ষতি দেখা দেয়। এক কথায় একে বলা হয়ে থাকে ‘ছত্রভঙ্গন্তরঙ্গমে’। ঘোড়া অত্যন্ত ক্ষিপ্র, বুদ্ধিমান ও প্রভুভক্ত। তবুও কখনও কখনও তার আচরণে উদভ্রান্ত ভাব লক্ষ্য করা যায়। ঘোড়ার এই স্বভাবের প্রভাব পড়ে মর্ত্যলোকে।
এ ছাড়া আরও একটা দিকের কথা জানান হিন্দুশাস্ত্র পণ্ডিতরা। মঙ্গল অথবা শনিবারের যাত্রা হলে দেবীর বাহন হয় ঘোটক। শাস্ত্রবিদদের মতে, মঙ্গলগ্রহ তেজস্বী ও বীরদর্পী। আর শনি হল কূট বুদ্ধিসম্পন্ন। প্রায়শই অনিষ্টকারী। তাই দেবীর ঘোড়ায় গমনাগমন হলে এই দুই গ্রহের প্রভাব পড়ে পৃথিবীতে।নৌকাং জলবৃদ্ধিশ্চ শষ্যবৃদ্ধির্ভপেৎ সদা’। কথাটির অর্থ হল দেবী দুর্গা নৌকায় গমনাগমন করলে মর্ত্যভূমিতে শস্য খুব ভালো হয়।
কিন্তু, অতি বৃষ্টি বা বন্যার আশঙ্কাও থাকে। এক কথায় – জল বৃদ্ধির প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে মর্ত্যভূমিতে। নৌকা কোনো উৎকৃষ্ট জলযান নয়। বিপদের ঝুঁকিযুক্ত দোদুল্যমান একটি জলযান। ফলে মায়ের আগমনের পর জলের একটা প্রভাব দেখা দেয় প্রকৃতিতে। যেমন অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি। দুর্গা বুধবার যাতায়াত করলেই তার যানবাহন হয় নৌকা।মহালয়ার ভোরে খুলনার শ্মশান কালী মন্দিরে প্রথমে চণ্ডীপাঠ ও পরে মায়ের আগমণী গান অনুষ্ঠিত হয়।
সবশেষে ছিল গীতিনাট্য মহিষাসুর মর্দিনী মা দুর্গার পরিবেশনা।বরিশাল, সিলেটসহ দেশের সব জেলায় নানা আয়োজনে মহালয়া উদযাপন হয়।