নিজস্ব প্রতিবেদক :
মাত্র দুই লক্ষ টাকা দিয়ে বিদেশ পাঠানোর নাম করে মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
রোববার (১০ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজারের পেকুয়ায় অভিযান চালিয়ে র্যাব ৭ এর একটি টিম তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তাররা হলেন—বাঁশখালী ছনুয়া এলাকার মোজাফফর আহম্মদের ছেলে মো. ইসমাইল ও শফিউল আলম, একই এলাকার মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে মো. হোসেন, পশ্চিম সেলবন এলাকার মৃত সৈয়দ আহাম্মদের ছেলে মো. ইউনুছ মাঝি এবং পেকুয়ার রাজাখালী এলাকার সেকান্দার আলীর ছেলে রিয়াজ খান রাজু।
র্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নূরুল আবছার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এসময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট ও এনআইডি কার্ড এবং বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
সোমবার (১১ এপ্রিল) দুপুরে বহদ্দারহাটস্থ চান্দগাঁও র্র্যাবের কার্যালয়ে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে করে বাহিনীটি।
র্যাবের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ এ সংবাদ সম্মেলনে জানান, স্বল্প খরচে মালেশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নাম করে ট্রলারে করে অজ্ঞাত দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিতো চক্রটি। প্রথমে চুক্তির কিঞ্চিৎ পরিমাণ টাকা হাতে নিয়ে পরে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বাকি অর্থ দাবি করতো। দিতে না পারলে স্বাক্ষরযুক্ত স্ট্যাম্পের মাধ্যমে তাদের আবাদি জমি জমা বাড়ি-ঘর দখল করে নিতো। এলাকায় তারা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ কিংবা কথা বলার সাহস পেতো না।
তিনি আরও বলেন, দুই সহোদরের মানবপাচার ব্যবসা কক্সবাজারের পেকুয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা এলাকার নিরীহ মানুষের দারিদ্রতার সুযোগে স্বল্প খরচে বিদেশ পাঠানোর নাম করে টাকা হাতিয়ে নিতো গ্রেপ্তার ইসমাইল হোসেন ও তার ভাই শফিউল আলম। শুরুতে কিছু টাকা নিয়ে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখে পাসপোর্ট বানাতে দিতো তারা। তাদের দুজনের নামেই বিভিন্ন থানায় ৭টি করে মানব পাচার আইনে মামলা আছে।
র্যাবের অধিনায়ক বলেন, দুই সহোদরের মানবপাচার ব্যবসার সহযোগী পেকুয়ার রাজু। অর্থাৎ ইসমাইল ও শফিউলের মানবপাচার ব্যবসার অন্যতম সহযোগী হলেন রিয়াজ খাঁন রাজু। বিদেশ যাত্রায় আগ্রহী লোকজনের কাগজপত্র সংগ্রহ করে পাসপোর্ট বানিয়ে দিতেন তিনি। পাসপোর্ট বানিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতেন যে—তাদের মাধ্যমে স্বল্প খরচে মালেশিয়া যাওয়া সম্ভব। আর বিদেশ যেতে আগ্রহী নিরীহ লোকজন তাদের এই ফাঁদে পা দিয়ে মোট খরচের অর্ধেক টাকা রাজুর কাছে জমা করতো। বাকি টাকা মালেশিয়া পৌঁছে দেওয়ার শর্তে রাজু তাদের ট্রলারে তুলে দেওয়ার আগমুহুর্তে পাসপোর্ট রেখে দিতো। তাদের এই কাজে সহযোগিতা করতো গ্রেপ্তার ইউনুছ।
র্যাবের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ আরও বলেন, এদিকে রাজুর ভয়ে মুখ খুলতো না কেউ। রাজু স্থানীয়ভাবে পেকুয়া উপজেলা এলাকায় একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার ভয়ে এলাকার কোন লোক কথা বলার সাহস পায় না। তার সাথে বিবাদে জড়াতে গেলে বাড়িঘর দখল করে বাড়ি ছাড়া করে দেয়। তার ভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করার সাহস পায় না। জয়নাল আবেদিন নামে এক ভুক্তভোগী রাজুকে বিশ্বাস করে তার কাছে পাসপোর্ট তৈরি করতে যায়। রাজু তাকে পাসপোর্ট তৈরির কারণ জানতে চাইলে ভুক্তভোগী জয়নাল আবেদীন সুযোগ হলে বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানান। তখন রাজু ভিকটিমকে স্বল্প খরচে মালেশিয়া যাওয়ার সেই টোপ দেয়। তার সেই ফাঁদে পা দিয়ে জয়নাল আবেদীন প্রাথমিকভাবে তাকে ১৫ হাজার টাকা দেয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই রাজু জয়নাল আবেদীনের পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়। পাসপোর্ট পেয়ে ভিকটিম আরও ১ লাখ টাকা তুলে দেয় রাজুর হাতে। এসময় রাজু বাকি টাকা মালেশিয়া পৌঁছে পরিশোধের কথা জানায়। টাকা দেওয়ার ১৫ দিন পর পেকুয়ার একটি ঘাট থেকে ট্রলারে উঠিয়ে দেয় রাজু। ওই ট্রলারে মানব পাচার চক্রের আরও কয়েকজন সদস্যসহ ১৫ থেকে ২০ জন ভুক্তভোগী ছিল। ২ থেকে ৩ দিন গভীর সাগরে ঘোরাফের করে হঠাৎ গভীর রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে তাদের নামিয়ে দেয়। সকাল হলেই ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারে মালেশিয়া নয় তারা সেন্টমার্টিনে। সেখানে ভুক্তভোগীরা কয়েকদিন মানবেতর জীবন যাপন করে যার মতো করে বাড়ি ফিরে। এ ঘটনায় ভিকটিম জয়নাল আবেদীন বাড়ি ফিরে রাজুর কাছে টাকা ফেরত চাইলে তাকে মারধর করে এবং অপহরণ করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
মোজাম্বিকে পাঠিয়ে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতো এই চক্রটি। মোক্তার আলী নামে এক ভুক্তভোগী গ্রেপ্তার এমরানের মাধ্যমে মোজাম্বিক যায়। সেখানে গিয়ে ওই মানব পাচার চক্রের হাতে অপহরণ হয় মোক্তার। পরে তাকে মুক্তি দিতে অপহরণকারীরা ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা দাবি করে। এমরানের কথা মতো মোক্তার আলীর ভাই জয়নাল আবেদীন তার ভাইকে ফিরে পেতে এমরানের বাবা হোসেন আলীকে টাকা দিয়ে আসে। এরপরও মোক্তার আলীর কোন খোঁজ না পাওয়া জয়নাল আবেদীন বাদী হয়ে আলী হোসেন, তার দুই ছেলেসহ আরও ৪ জনের বিরুদ্ধে বাঁশখালী থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করে। গ্রেপ্তার মো. হোসেন তার ছেলের মাধ্যমে নীরিহ লোকজনকে মোজাম্বিক পাঠিয়ে মানব পাচার চক্রের সাহায্যে অপহরণ করে বাংলাদেশি আত্বীয় স্বজন থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করতো।