আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিশ্ব পরিমণ্ডলে অন্যতম এক বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভূত হওয়ার পেছনে অনবদ্য অবদান রাখা দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন মারা গেছেন।
বুধবার (৩০ নভেম্বর) ৯৬ বছর বয়সে চীনের সাবেক এই নেতা মারা গেছেন বলে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে।
চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া বলেছে, বুধবার স্থানীয় সময় বেলা ১২টা ১৩ মিনিটে মারা গেছেন জিয়াং। দীর্ঘদিন ধরে প্রাণঘাতী লিউকেমিয়াসহ একাধিক জটিল রোগে ভোগার পর সাংহাই শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।
দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি, সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং সামরিক বাহিনী সাবেক এই নেতার মৃত্যুর ঘোষণা দিয়ে চীনা জনগণের কাছে একটি চিঠি প্রকাশ করেছে। চিঠিতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ‘কমরেড জিয়াং জেমিনের মৃত্যু আমাদের পার্টি, সামরিক বাহিনী এবং আমাদের সব জাতিগোষ্ঠীর জনগণের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।’এতে জিয়াং জেমিনকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন একজন অসামান্য নেতা, মহান মার্কসবাদী, রাষ্ট্রনায়ক, সমর কৌশলবিদ, কূটনীতিক এবং দীর্ঘ পরীক্ষিত কমিউনিস্ট যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিয়াং জেমিনের মৃত্যুতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান অফিস, সরকারি বিভিন্ন ভবন ও বিশ্বজুড়ে চীনা দূতাবাস ও কনস্যুলেটে চীনের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সিসি টিভি বলছে, জিয়াংয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যবস্থাপনা কমিটির এই আদেশ বুধবার থেকে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তারিখ পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। তবে দেশটির সাবেক এই নেতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তারিখ এখনও ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
১৯৮৯ সালে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের ওপর রক্তাক্ত তিয়ানআনমেন অভিযানের কিছুদিন পর জিয়াংকে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর চীনের পরবর্তী কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক মেরামত এবং নজিরবিহীন অর্থনৈতিক উত্থানের তত্ত্বাবধান করেন তিনি।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী পরিবর্তনের মাধ্যমে চীনকে দেখেছেন জিয়াং; যার মধ্যে রয়েছে বাজার-ভিত্তিক সংস্কার ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন, ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে হংকংয়ের প্রত্যাবর্তন এবং ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) বেইজিংয়ের প্রবেশ।
তবে জিয়াং নেতৃত্বাধীন চীনের তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে দেশে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। বাইরের বিশ্বের জন্য চীন উন্মুক্ত হলেও দেশে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অভিযানের জেরে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল জিয়াংয়ের সরকার।
সেই সময় মানবাধিকারকর্মী, শ্রমিক নেতা এবং গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের কারাবন্দি করে জিয়াং নেতৃত্বাধীন চীনা সরকার। দেশটির আধ্যাত্মিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসা ‘ফালুন গং’কেও নিষিদ্ধ করা হয়; এই গোষ্ঠীকে তখন কমিউনিস্ট পার্টির একচেটিয়া ক্ষমতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হতো।
প্রায় ১৩ বছর ধরে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান এবং কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করলেও জিয়াং কখনোই তার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত ছিলেন না। বরং পার্টির ভিন্ন ভিন্ন বিভিন্ন মতাবলম্বীদের জন্য একজন দক্ষ প্রশাসক এবং আপোসকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।
২০০২ সালে হু জিনতাওয়ের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যাপক পরিবর্তনের পর জিয়াং তার ক্ষমতার শিখরে পৌঁছান বলে মনে করা হয়। দীর্ঘ সময়ের জন্য তিনি দলটিতে ‘শক্তিশালী ব্যক্তি’ হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখেন। দলের নেতাকর্মীদের মাঝে ‘দ্য সিনিয়র’ (ঝাংঝে) নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
২০০৪ সালে সরকারি উপাধি ত্যাগ করলেও ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসা বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উত্থানের পেছনে ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করেন জিয়াং। জিয়াংয়ের অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মিশ্রণে এখনও আটকে আছেন শি জিনপিং।
প্রাথমিকভাবে ক্রান্তিকালীন নেতা হিসাবে দেখা হতো জিয়াংকে। যিনি দল ও দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা দেং জিয়াওপিংয়ের ম্যান্ডেটে কাজ করেছিলেন। দেশটির সংস্কারকামী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন জিয়াং।তার ক্ষমতার ১৩ বছরে চীনের শীর্ষ পদ অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দলটিতে পুঁজিবাদীদের স্বাগত জানিয়েছিলেন।
এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় বেইজিংয়ের যোগদানের পর বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের পথ দেখান তিনি।
চীনের বিশ্ব শক্তি হয়ে ওঠার পেছনে অসামান্য ভূমিকা রাখা জিয়াংকে তার শেষ সময়গুলোতে বেশ বিবর্ণই দেখা গেছে। কিছুটা আড়ালে চলে যাওয়া চীনা এই নেতাকে সর্বশেষ ২০১৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন গেটে বর্তমান ও সাবেক নেতাদের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে দেখা যায়।