চট্টলা ডেস্ক :
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি পেয়ে ক্ষুব্ধ পুলিশ কর্মকর্তারা।
চিঠির বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা নাখোশ হয়ে বলছেন, জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই।
গত ২৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশ দিয়ে বলা হয় প্রতিদিন জেলা প্রশাসকদের কাছে মামলা ও সাধারণ ডায়েরির তথ্য দিতে হবে জেলার পুলিশ সুপারদের।
অভিযোগ রয়েছে অনেক জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) জেলার ডিসিদের মামলা ও জিডির তথ্য সরবরাহ করেন না। এ নিয়ে এসপি ও ডিসিদের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকেই সমন্বয়হীনতা চলে আসছে। আর এ কারণে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফলপ্রসূভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে চিঠির বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক গতকাল মঙ্গলবার রাতে বলেন, জেলা পুলিশ আর জেলা প্রশাসকরা সমন্বয় করেই কাজকর্ম চালাচ্ছে। মাসে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মিটিংয়ে মামলা বা জিডির তথ্য দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিদিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠানোর বিষয়টি আমার চাকরি জীবনের ৩২ বছরেও দেখিনি। বিচারিক ক্ষমতায় আছে যেসব আদালত সেখানে মামলা ও জিডির তথ্য দিতে পারবে পুলিশ। হঠাৎ কেন মন্ত্রণালয় এই চিঠি দিল তা বুঝতে পারছি না। এতে ডিসি-এসপিদের মধ্যে সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। একে অন্যকে ভুল বুঝবে। আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি সুরাহা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এক সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা পুলিশের কাছ থেকে নিয়মিত তথ্য পেত। এখন কিন্তু তা হচ্ছে না। এসপি ও ডিসিদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। চিঠির উদ্দেশ্য যদি হয় ‘এসপি ও ডিসিদের’ সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা তাহলে ঠিক আছে।
তিনি আরও বলেন, যেভাবে প্রশাসন চলছে তা হতে পারে না। সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। এখন যদি পুলিশ বা ডিসিরা বলেন, তাদের মধ্যে ঐক্য আছে তাহলে তো ভালো। তবে আমার তা বিশ্বাস হচ্ছে না। মানুষের কল্যাণে তাদের মধ্যে কতটুকু ঐক্য আছে তা গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জেলার ডিসি ও এসপিদের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ নেই। জেলার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠকগুলোতে পুলিশ নিয়মিত অংশ নেয়। কখনো আলাদা করে জেলা প্রশাসকদের মামলা বা জিডির বিষয়ে জানাতে হয় না। জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয় উপস্থাপন করে থাকে জেলা পুলিশ। এমন কী ঘটনা ঘটল যে মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিয়েছে ডিসিদের কাছে মামলা ও জিডির তথ্য দিতে হবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা ডিসিসহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করছি। চিঠিটি পেয়ে আমরা সত্যিই খুবই হতাশ। এতে আরও তিক্ততা বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছি। ইতিমধ্যে চিঠির বিষয়টি আইজিপির নজরে এসেছে। এই নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তর কথা বলবে। বিষয়টি কীভাবে সুরাহা করা যায় তা নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই কিছু কিছু জেলায় ডিসি ও জেলা পুলিশ সুপারদের মধ্যে কিছুটা বিরোধ চলছে। ডিসি বা পুলিশ কর্মকর্তারা যখন মিটিং করেন সেখানে অনেকে যান না বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। চলতি বছরের মে মাসে এটি গোপনীয় প্রতিবেদনেও নানা ধরনের বিরোধ ও মতানৈক্যসংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য এসেছে। এসব মতানৈক্যের কারণে জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসপিদেরও কোনো কথা শোনেন না জেলা প্রশাসকরা। বিষয়টি সুরাহা করতেই পিআরবিতে উল্লিখিত প্রবিধান স্মরণ করিয়ে দিয়ে ডিসিদের কাছে মামলা ও জিডির সংক্ষিপ্ত তথ্য সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে চিঠি ইস্যু করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা কাজ করছে। করোনা প্রকোপের আগে হওয়া নিয়মিত ডিসি কনফারেন্সে জেলা প্রশাসকরা বারবার অভিযোগ করে আসছেন পুলিশ তাদের কোনো ধরনের সহায়তা করে না। তবে ডিসিদের ওইসব অভিযোগ পুলিশ কর্মকর্তারা অস্বীকার করে আসছেন। দেশের প্রয়োজনে যেকোনো স্থানে ডিসিদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে আসছে পুলিশ। জেলা প্রশাসকদের নিয়ন্ত্রণাধীন ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর সময় পুলিশ নিয়োজিত করা হয়। তাছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টিও রয়েছে।
মাসিক আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মিটিংয়ে জেলার সবকটি থানার মামলা ও সাধারণ ডায়েরির বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। আর জেলা প্রশাসকরা বারবার অভিযোগ করে আসছেন কোনো কাজেই পুলিশকে পাওয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মিটিংয়ে জেলার এসপিরা উপস্থিত থাকেন না। এডিশনাল এসপি ও তার নিচের কাউকে মিটিংয়ে পাঠানো হয়। তারা ঠিকমতো তথ্য উপস্থাপন করতে পারেন না।
এসব অভিযোগ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, আইজিপি ও জেলা প্রশাসকদের নিয়ে একাধিকবার বৈঠকও হয়েছে।
গত ২৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব জুবাইদা মান্নান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, থানার মামলার এফআইআর ও জেনারেল ডায়েরির (জিডি) তথ্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিচ্ছে না পুলিশ। পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী থানার প্রতিদিনের মামলা ও জিডির তথ্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল-১৯৪৩ এর ১৯২ প্রবিধান অনুসারে সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) তার পুলিশ সুপারের মাধ্যমে এফআইআর ও জেনারেল ডায়েরি থেকে তথ্যের ভিত্তিতে বিপি ফরম-১৬ পূরণ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিদিন দেওয়ার বিধান আছে। তবে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে নিয়মিত তথ্য না দেওয়ায় জেলা পর্যায়ে স্থানীয় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফলপ্রসূভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
চিঠির আরেকটি অংশে উল্লেখ করা হয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনকৃত অনুশাসন রয়েছে। চিঠিটি ওইদিনই পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছেছে। চিঠি পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও নড়েচড়ে বসেছেন।
গতকাল পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন আইজিপি।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, চিঠির বিষয়টি নিয়ে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে কথা বলব। তাছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও আলাদাভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবে। ব্রিটিশ আমলের আইনে তো অনেক কথাই বলা আছে। সব কথা কি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে? প্রতিদিন কেন জেলা প্রশাসকদের তথ্য দিতে হবে? মাসে একবার তাদের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একাধিকবার জেলা পুলিশ, রেঞ্জ ডিআইজিসহ পুলিশের অন্যন্যা ইউনিটকে নির্দেশনা পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে। পুলিশ তো সব নির্দেশই মানছে। তারপরও কেন মন্ত্রণালয় চিঠি দিল তা বুঝতে পারছি না। আমরা রাষ্ট্রের জন্য কাজ করি। কেউ আমাদের প্রতিপক্ষ না। আশা করি চিঠির বিষয়টি সুুরাহা হবে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) বলেন, চিঠির তথ্য দেখে খুব হতাশ হয়েছি। জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করেই আমরা কাজ করছি। প্রতিদিন মামলা বা জিডির তথ্য জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয় না। প্রতি মাসে জেলার আইনশৃঙ্খলার মিটিং হয়। মিটিংয়ের দুয়েক দিন আগে বা মিটিংয়ের দিন সবকটি থানার মামলার সংখ্যা এবং কোন থানায় কী ধরনের জিডি হয়েছে তা পাঠানো হয়। মাঝেমধ্যে জেলা প্রশাসক থানা পরিদর্শনে এলে এসবের খোঁজখবর নেন। মোবাইল কোর্ট চালালে পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করে।
পুলিশ সুপাররা আরও বলেন, ব্রিটিশ আমলে জেলার সবকিছু জেলা প্রশাসককে কেন্দ্র করে চলত। এখন সময় পাল্টেছে। আবার কাজের ধরনও বদলে গেছে। আর মামলা ও জিডির তথ্য না পাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কীভাবে ফলপ্রসূভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে সেটাও বোধগম্য নয়। দেশে তো বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে।
পিআরবি-১৯৪৩ এর ১৯২ প্রবিধানে বলা হয়েছে, সার্কেল ইন্সপেক্টররা এফআইআর ও জিডি থেকে বিপি ফরম-১৬ অনুযায়ী একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন। প্রতিবেদনটি মহকুমা পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে উপবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দেবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার মন্তব্য এবং প্রতিবেদনের আদেশ রেকর্ড করার পর সেগুলো রেকর্ডের জন্য সুপারিনটেন্ডেন্টের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। যেখানে ওপরের পদ্ধতিতে বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতে অথবা যেখানে পরিদর্শকের কার্যালয় মহকুমার সদর দপ্তর নয়, সেখানে প্রতিবেদনগুলো পেন কার্বন প্রক্রিয়ায় নকল করে একটি কপি পাঠানো হবে সরাসরি সুপারের কাছে।
এ প্রতিবেদনে দেখানো হবে যেসব মামলা এবং অস্বাভাবিক ঘটনা, প্রতিবেদন করা সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা অধস্তন পুলিশ দ্বারা রিপোর্ট করা হয়েছে অথবা অন্য কোনো উপায়ে পরিদর্শকের নোটিসে এসেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে থানায় হওয়া মামলার কপিগুলো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এবং মামলায় কোনো আসামি গ্রেপ্তার থাকলে তাকেও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হয়। মহানগর এলাকায় মামলার তথ্য চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানো হয়। সাধারণত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তথ্য দেওয়া হয় না। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ হয়নি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিসিদের মামলা ও জিডির তথ্য সরবরাহ প্রসঙ্গে পুরনো আইন রয়েছে।